হতাশ: নিজের অফিসে দুই গাঁধীর ছবির সামনে ইয়াসমিন খান। (ডান দিকে) আফগানিস্তানে পড়ে থাকা পরিজনদের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন এ শহরের কাবুলিওয়ালারা। সোমবার, ভবানীপুরের ডেরায়। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
মেহমানদারির উত্তাপ ফিকে হয়নি। তবে এই দুঃসময়ে গাঢ় হচ্ছে অনিশ্চয়তা। বৌবাজারের তস্য গলি গুমঘর লেনের স্যাঁতসেঁতে উঠোন পেরিয়ে ‘খান-কোঠি’। সবুজ কার্পেট পাতা ঘরের চেহারায় বিশেষ কোনও অদলবদল হয়নি। কিন্তু আয়েশি বিকেলে কাঠবাদাম, পেস্তা সহযোগে ‘গ্রিন টি’র চিরাচরিত আপ্যায়নে ফাঁক থেকে গেল।
নোটবন্দির হতাশাতেও এতটা ভেঙে পড়েননি কলকাতার কাবুলিওয়ালারা। রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী কার্ডধারী মহম্মদ নবি বরং ফুরফুরে মেজাজেই তাঁর হিন্দুস্থানে পালানোর গল্প শুনিয়েছিলেন। কাবুলের দক্ষিণে পাকতিকা প্রদেশে হাত-সাফাইয়ের খেলা দেখানোর দরুণ তালিবান নবির পায়ে গুলি করেছিল। নোটবন্দির দিনে কাবুলে বৌ, মেয়েকে টাকা পাঠানো নিয়েই তিনি ব্যস্ত ছিলেন। পাঁচ বছর বাদে আফগান মুলুকে দুঃস্বপ্নের দিন ফিরে আসার পরে নবির ফোনে কিছুতেই সাড়া মিলল না।
গুমঘর লেনের ডেরার কাবুলিওয়ালারা মুখ খুলতে চাননি। তবে সোমবার বিকেলে পাকতিকার ২১ বছরের এক সদ্য তরুণ কথা বলছিলেন। বাপ-দাদার সূত্র ধরে কলকাতার সঙ্গে তাঁর কয়েক পুরুষের যোগাযোগ। সুদের কারবারই বেছে নিয়েছেন। তবে এখন নাম প্রকাশে সাহস পাচ্ছেন না। নিজের গ্রামের এক যুবকের সঙ্গেই থাকেন সিআইটি রোডে। বিকেল চারটে নাগাদ ফোনে কথা বলেছেন দেশে থাকা মা-বাবার সঙ্গে। তিনি স্তম্ভিত, ‘‘এই তো, কাবুলের ৮০ কিলোমিটার দূরে মুথাখান দখল করতেই তালিবানের দু’-দু’মাস লেগে গেল। প্রায় ১১০০ তালিবান সেই যুদ্ধে মারাও গিয়েছে। হেলমন্দের লস্কর গায়েও দেড় মাস টক্কর চলেছে। কিন্তু কাবুল কী ভাবে এমন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল, সেটাই মাথায় ঢুকছে না।’’ বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলে তিনি যা বুঝেছেন, খোদ পূর্বতন সরকারপক্ষ এবং সেনাবাহিনীর একাংশের সায় না-থাকলে কিছুতেই তালিবান এত সহজে দেশটা দখল করতে পারত না!
ভয়ার্ত: দেশ ছেড়ে পালাতে পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে বিমানবন্দরের দিকে দৌড়। সোমবার, কাবুলে। ছবি: রয়টার্স
‘‘সব শেষ হয়ে গেল! জানি না, আর কোনও দিন দেশটাকে দেখতে পাব কি না! মা, বাবা, বোনটাকেও যদি এখানে আনতে পারতাম! কলকাতায় তা-ও কোনও মতে চলছে। আফগানিস্তানে সব অন্ধকার’’, হতাশার সুরে ভাঙা ভাঙা হিন্দি, ইংরেজিতে কথাগুলো বলছিলেন পাকতিকার তরুণটি। তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন সীমান্ত গাঁধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত, ষাট ছুঁই ছুঁই মহিলা ইয়াসমিন খান। ভারতীয় পাখতুনদের সংগঠন ‘অল ইন্ডিয়া পাখতুন জিরগা হিন্দ’-এর তিনি সভানেত্রী। পার্ক সার্কাসের চাঁদতারা মসজিদের কাছের অফিস-কাম-আস্তানায় ফ্রেমে বাঁধানো মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী ও সীমান্ত গাঁধীর ছবি। স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্বের নারী দৃঢ় স্বরে বললেন, ‘‘আফগানিস্তানে শতকরা ৯৫ ভাগ লোকই তালিবানকে চায় না, তবু দেশটা চক্রান্তেরই শিকার হল। কলকাতায় ৮০টা খান-কোঠি রয়েছে। এখানকার কাবুলিরা সক্কলে এই কথাই বলবে!’’
বাস্তবিকই কথাগুলো অবিকল মিলে যাচ্ছে ভবানীপুরে দেবেন্দ্র ঘোষ রোডের মসজিদ লাগোয়া ডেরায় গুল মহম্মদ, রুজ়ি খান, আখাদ খানদের সঙ্গে। সবুজ কার্পেট পাতা লম্বাটে ঘরে কলকাতার চিরকেলে কাবুলি ডেরা। আসবাব বলতে টাকা রাখার আলমারি আর পিকদান। গেল ইদেও ময়দানে ডিম নিয়ে বাজি ধরার মজাদার খেলায় তাঁরা জড়ো হয়েছিলেন। অনেকেরই বৌ বাঙালি। কাঁটা বেছে মাছ খেতে শিখেছেন। টিভিতে পাক প্রেসিডেন্ট ইমরান খানকে দেখেই ফুঁসে উঠছেন কাবুলিওয়ালারা। ‘‘এরাই যত নষ্টের গোড়া। তালিবানের মধ্যেও নিশ্চিত ভাবে পাকিস্তানিরা মিশে।’’ ইয়াসমিনও বলছিলেন, ‘‘আমি তো এক জন মহিলা হয়েও ভারতে বসবাসকারী পাখতুনদের নেত্রী! তালিবান যা করছে, তা মোটেও ইসলামের নামে করা চলে না! তবে এর পিছনে ইসলামাবাদের কী ইন্ধন, তা বলতে পারব না!’’
ইয়াসমিনের বাপ-ঠাকুরদার দেশ আফগান মুলুকের জলালাবাদে। তাঁর বাবা, প্রয়াত খান লালাজান খান স্বয়ং বাচ্চা খান তথা সীমান্ত গাঁধীর স্নেহধন্য। তালিবানের হাতে নিহত আফগান প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লার সঙ্গেও লালাজানের বন্ধুতা ছিল। বাবার সঙ্গে একটি সম্মেলনে যোগ দিতে তরুণ বয়সে ইয়াসমিনও এক বার কাবুল দেখেছেন ১৯৮৬ নাগাদ। তালিবানের পুনরুত্থান মানে বাচ্চা খানের আদর্শ ধ্বস্ত হওয়ার বেদনাই বিঁধছে তাঁকে। পাকিস্তানের দিকে সন্দেহের তির ছাড়াও আমেরিকার ভূমিকাতেও বিস্ময় ও ক্ষোভ দানা বাঁধছে কলকাতার কাবুলিদের মধ্যে। ভবানীপুরের ডেরায় গুল মহম্মদ বলছিলেন, ‘‘আমরা বেশির ভাগই এখানে ভারতীয়! আমি কখনও আফগানিস্তানে যাইওনি! তবে দাদা-পরদাদার দেশটা এক বার দেখার ইচ্ছে ছিল। আমেরিকা যা করল, তা তো দেখলেনই! আফগানিস্তান কিন্তু এখন ভারতের দিকেই তাকিয়ে আছে।’’