‘ম্যাডাম’ ডাকই এনে দিল পূর্ণতা

হিরন্ময় দে থেকে সুচিত্রা দে। এই পরিবর্তন মেনে নিয়েছিল আমার ছাত্রেরা। অনেক পরে মা-ও মেনে নেন। কিন্তু তত দিনে আমি নানা ভাবে ক্ষতবিক্ষত। শিক্ষিকা হিসেবে নতুন চাকরি খুঁজতে গিয়ে বারবার এমন বহু প্রশ্ন শুনতে হয়েছে, যার সঙ্গে শিক্ষকতার কোনও সম্পর্ক নেই।

Advertisement

সুচিত্রা দে

শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১১:১৪
Share:

সুচিত্রা দে। —নিজস্ব চিত্র

দিনটা কখনও ভুলব না। নিজেকে যতই শান্ত রাখার চেষ্টা করছি, হাত-পা ততই ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। সে দিন শার্ট, ট্রাউজার্স পরিনি। শাড়ি পরেছিলাম। চোখে কাজল। চুল খোঁপা করা।

Advertisement

ক্লাসে ঢুকে ভূগোল বই খুলে মালভূমি বিষয়টি পড়াব ভাবছি। গলা থেকে যেন আওয়াজই বেরোচ্ছে না। মনে হল, ঢুকেই বোর্ডে আগে কিছু একটা লিখে ফেলব। ছাত্র-ছাত্রীদের আমার নতুন চেহারার সঙ্গে ধাতস্থ হওয়ার সময় দেব কিছুটা। কে জানে, ওরা কী ভাবে নেবে! নানা চিন্তা, সমীকরণের জট ছাড়াতে ছাড়াতে ক্লাসে ঢুকলাম। পা কাঁপছে! হঠাৎ কেমন যেন সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। প্রথম বা দ্বিতীয় বেঞ্চ থেকে এক ছাত্র বলে উঠল, ‘‘গুড আফটারনুন ম্যাডাম!’’ সেই প্রথম মনে হল, আমি প্রকৃত নারী।

হিরন্ময় দে থেকে সুচিত্রা দে। এই পরিবর্তন মেনে নিয়েছিল আমার ছাত্রেরা। অনেক পরে মা-ও মেনে নেন। কিন্তু তত দিনে আমি নানা ভাবে ক্ষতবিক্ষত। শিক্ষিকা হিসেবে নতুন চাকরি খুঁজতে গিয়ে বারবার এমন বহু প্রশ্ন শুনতে হয়েছে, যার সঙ্গে শিক্ষকতার কোনও সম্পর্ক নেই। শিক্ষক, পরিষ্কার করে বলতে গেলে, বহু কলেজ-স্কুলের প্রধানেরাই ইন্টারভিউতে জানতে চেয়েছিলেন, সঙ্গমের পরে আমি সন্তানের জন্ম দিতে পারব কি না! প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘‘সন্তানদের ব্রেস্ট ফিড করানোর ক্ষমতা আছে কি তোমার!’’ ওই শিক্ষক-অধ্যক্ষদের কারও আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা বা পড়ানোর ধরন নিয়ে কিছু জানার ইচ্ছে ছিল না। তাঁরা শুধু আমার শরীর নিয়ে জানতে চেয়েছেন। পরে আর তাঁদের প্রতিষ্ঠানে কাজও দেননি। ঠাকুরপুকুরে আগের স্কুলেই পড়াই এখনও। এখানেই পুরুষ হিসেবে ক্লাস নিয়েছি, এখন নারী হিসেবেও।

Advertisement

ছোট থেকেই ‘অ্যাকিউট জেন্ডার ডিসফোরিয়া’-এ ভুগতাম। সপ্তম শ্রেণিতে যখন পড়ি, হঠাৎ বাবা মারা গেলেন। আমাদের পারিবারিক ব্যবসার আয়ে কোনও রকমে সংসার চালাতেন মা। মেয়ের সমস্যা তাঁকে যে কী পরিমাণ মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে, আজ বুঝি। তত দিনে দু’দফায় ভূগোল এবং ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর পাশ করেছি। বিএড করাও হয়ে গিয়েছে। ঠাকুরপুকুরের এখনকার স্কুলেই তখন চাকরি করি। এক দিন সিদ্ধান্ত নিলাম, রূপান্তরিত হব। তবে দিল্লি গিয়ে ঠকে গিয়েছিলাম। ২০১৭ সালের মে মাসে ৮০ হাজার টাকার ব্যবস্থা করে অস্ত্রোপচার করাই। তা সফল হয়নি। কলকাতায় ফিরে তখন এক বন্ধুর বাড়িতে থাকি। প্রবল শারীরিক যন্ত্রণা শুরু হল। সঙ্গে রক্তপাত। এখানকার চিকিৎসকেরা বললেন, আগে ভুল অস্ত্রোপচার হয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে আবার অস্ত্রোপচার করালাম। এ বার আমি সম্পূর্ণ নারী। তবে আমার এই পরিবর্তন পরিবারের বাকিরা মেনে নিতে পারলেন না। এক দাদা এবং এক দিদি আছেন আমার। তাঁরা আলাদা থাকতে শুরু করলেন। তবে আমার ছাত্র-ছাত্রীরা অসময়ে পাশে থেকেছে। পাশে থেকেছে আমার পুরনো স্কুলও। এখনও সমাজ আমাদের স্বাভাবিক ভাবে নেয় না ঠিকই। তবু সব ভুলে এগিয়ে যেতে পারি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের ভালবাসার জোরেই!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement