— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
কখনও আবাসিককে পিটিয়ে মারার অভিযোগ ওঠে। কখনও মৃত্যুর কারণ সামনে আসে না বহু বছরেও। বলে দেওয়া হয়, নেশার তাড়নায় আবাসিক অশান্ত হয়ে পড়েছিলেন। শান্ত করার সময়েই হৃদ্রোগে তাঁর মৃত্যু ঘটেছে! অথচ, শরীরে আঘাতের চিহ্ন, কালশিটে! কিছু ক্ষেত্রে আবার জানানো হয়, পালাতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গিয়েছেন আবাসিক। নয়তো বলা হয়, আবাসিক নিজেই নিজেকে শেষ করে ফেলেছেন!
কিন্তু নেশামুক্তি কেন্দ্রের চার দেওয়ালের মধ্যে আদতে কী ঘটে, বহু ক্ষেত্রেই মৃতের পরিবারের কাছে তা অজানা থেকে যায় বলে অভিযোগ। কারণ, ভর্তির সময়েই পরিবারকে নেশামুক্তি কেন্দ্রের কর্তারা বলে দেন, ‘‘যাঁকে ভর্তি করানো হবে, তাঁকে ছেড়ে দিতে হবে আমাদের হাতে! দেখা করা যাবে না।’’ অভিযোগ, চিকিৎসক, মনোরোগ চিকিৎসকেরা নিয়মিত দেখবেন বলে জানানো হলেও তাঁদের সঙ্গেও পরিবারের লোকজনকে দেখা করতে দেওয়া হয় না। জোরাজুরি করলে বলা হয়, ‘‘যাঁকে ভর্তি করাচ্ছেন, ভেবে নিন, তাঁকে দূরে কোথাও ঘুরতে পাঠাচ্ছেন!’’
কেমন জীবন এমন নেশামুক্তি কেন্দ্রে? তারই খোঁজে বুধবার যাওয়া হয়েছিল ভিআইপি রোড সংলগ্ন এক নেশামুক্তি কেন্দ্রে। সেখানে ঘরের দেওয়াল জুড়ে লেখা, ‘সদিচ্ছা থাকলে অন্ধকার কেটে বেরোনো শুধু সময়ের অপেক্ষা।’ তবে, সেই
ঘরে আলোর দেখা নেই বললেই চলে। টিমটিম করে জ্বলছে একটি বাল্ব। সামনের চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছেন এক মাঝবয়সি। গলা শুনে চমকে উঠে বললেন, ‘‘আর ঢুকবেন না। এখানেই নাম লেখাতে হবে। কাকে ভর্তি করাবেন?’’ তাঁকে বলা হয়, আত্মীয় কোথায় থাকবেন, না দেখে ভর্তি করানো শক্ত। এ ক্ষেত্রেও একই রকম উত্তর আসে।
বেরোনোর মুখে দেখা হয় এক আবাসিকের আত্মীয়ের সঙ্গে। জরুরি জিনিসপত্র দিতে এসেছেন মহিলা। বললেন, ‘‘ছেলের কাছে
শুনেছি, এখানে একটি মাত্র হলঘরে ২২ জনকে রাখা হয়। মাত্র দু’টো জানলা। মাটিতে পাতা বিছানায় গাদাগাদি করে শুতে হয় সকলকে।’’ মহিলা জানান, শৌচাগারও একটাই। তবে, দরজা নেই! তবু এখানে রেখেছেন কেন? পরিচারিকার কাজ করা মহিলা কেঁদে ফেলেন। বলেন, ‘‘ছেলে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। অন্য উপায় চোখে পড়ছে না। সরকারি কিছু থাকলে সেখানেই দিতাম।’’
পরের গন্তব্য, বাঁশদ্রোণী প্লেসের একটি নেশামুক্তি কেন্দ্র। সেখানেই স্বামীর মৃত্যু হয়েছে বলে কিছু দিন আগে পুলিশে অভিযোগ করেন এক মহিলা। পুলিশের খাতায় এখন নাকি কেন্দ্রটি বন্ধ। তবে, পৌঁছে দেখা গেল, তেতলা ভবনে ২০ জন আবাসিক আছেন এখনও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রের মালিকের দাবি, ‘‘আইনি লড়াই চলছে। ওই রকম ঘটনা এখানে কখনও ঘটেনি। ভর্তির পরে দিন তিনেকের ওষুধের কোর্স করানো হয়। আমরাই ওষুধ খাওয়াই। ওই ব্যক্তির কী সমস্যা হয়েছিল, জানি না।’’ কিন্তু চিকিৎসক নন, আপনারাই ওষুধ খাওয়ান? মালিকের দাবি, ‘‘এত দিন নেশা ছাড়ানোর কাজ করছি! কী ওষুধ কী ভাবে খাওয়াতে হয়, ভালই জানি।’’
পরের গন্তব্য বেহালার রাজা রামমোহন রায় রোডের নেশামুক্তি কেন্দ্র। এক নাবালিকাকে নেশা ছাড়ানোর নামে ধর্ষণের অভিযোগে ২০১৮ সালে এই কেন্দ্রের মালিককে গ্রেফতার করা হয়। সেখানকার এক প্রাক্তন আবাসিকের অভিযোগ, ‘‘নরক-যন্ত্রণার মধ্যে কেটেছে। ছোট্ট ঘরে সাত-আট জনকে রাখা হত। একটাই জানলা। মেঝেতে মাদুর পেতে শোয়ার ব্যবস্থা। দিনে দু’বেলা খেতে দেওয়া হত, তা-ও অল্প পরিমাণে। একটাই শৌচাগার। সেটিরও দরজা ভাঙা। নগ্ন করে শারীরিক পরীক্ষা করা হত। প্রতিবাদ করলেই জুটত মার। অনেকেরই হাত শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হত।’’ ধৃত মালিকের এক আত্মীয় বর্তমানে কেন্দ্রটি চালান। তাঁর দাবি, ‘‘ডি-অ্যাডিকশন কঠিন পদ্ধতি। সামাল দিতে ধমক-চমকের সঙ্গে কখনও সখনও বেঁধেও রাখতে হয়।’’
কল্যাণীর একটি নেশামুক্তি কেন্দ্রে আবার কলকাতার এক তরুণীকে পরিবারের তরফেই জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করানোর ঘটনায় হুলস্থুল পড়েছিল দিনকয়েক আগে। সেই তরুণীর অভিযোগ, ‘‘১০ ফুট বাই ১২ ফুটের ঘরে আট জন মেয়েকে রাখা হয়েছিল। নেশাগ্রস্ত এবং মানসিক সমস্যায় ভোগা রোগীদের মধ্যে কোনও পার্থক্য ছিল না। ঘরটিতে কোনও জানলা ছিল না। শুধু খাবার দেওয়ার জন্য জানলার মতো একটি ব্যবস্থা ছিল। পোশাক খুলিয়ে গায়ে হাত দিয়ে পরীক্ষা করা হত। দু’দিনের সেই অন্ধকার জীবন এখনও চোখে ভাসে। ভাবি, চিকিৎসার নামে এই নরক-যন্ত্রণার মধ্যে যাঁদের ফেলে দেওয়া হয়, তাঁদের মুক্তির পথ কী? পুলিশ-প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েও উত্তর পাইনি।’’
(চলবে)