প্রতীকী চিত্র
‘প্রতি মাসেই দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুণ করে। তার পরেও এক শ্রেণির মানুষের হেলদোল নেই!’— আক্ষেপ শহরের এক চিকিৎসকের। গত ১ মার্চ কলকাতা ও সংলগ্ন তিন জেলায় (দুই ২৪ পরগনা এবং হাওড়া) দৈনিক করোনা আক্রান্তের যে সংখ্যা ছিল, ১ এপ্রিল সেই সংখ্যা যে ভাবে বেড়েছে, তাতে ‘সিঁদুরে মেঘ’ দেখছেন তাঁর মতো অন্য চিকিৎসকেরাও।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ থেকে চিকিৎসকদের একাংশ ফের করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করলেও সাধারণ মানুষের অনেকেই যে তাতে আমল দিচ্ছেন না, সেটা স্পষ্ট বাস্তব ছবিতে। মাস্ক ছাড়া, দূরত্ব-বিধি শিকেয় তুলে দোকান-বাজারে যাতায়াত করছেন এক শ্রেণির মানুষ। আচমকা তীব্র গরম পড়তেই অনেকে যুক্তি দিচ্ছেন, ‘‘মাস্ক পরে বেশি ক্ষণ থাকা সম্ভব হচ্ছে না।’’ আর এই পরিস্থিতি দেখে চিকিৎসকেরা বলছেন, ‘‘ভয়টা সেখানেই। মানুষ যত মাস্ক খুলে ঘুরবেন, তত বেশি সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা থাকবে।’’
বিশেষজ্ঞেরা এ-ও জানাচ্ছেন, গত এক-দেড় মাস ধরে ভোট ঘিরে শহরে যে ভাবে মিছিল-জনসভা হয়েছে, তার ফলই এখন মিলতে শুরু করেছে। পরিসংখ্যান
দেখে চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ১ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা কলকাতায় প্রায় ৮.২৮, উত্তর ২৪ পরগনায় প্রায় ৭, হাওড়ায় ১১.৩৬ এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনায় প্রায় ১৫.৭৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাঁদের একাংশের মতে, দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা ওঠানামা করতে করতেই হঠাৎ এক দিনে অনেক গুণ বেড়ে যেতে পারে।
যে কোনও অতিমারির ইতিহাস ঘাঁটলে দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রধান কারণ হিসেবে মানুষের ঢিলেঢালা আচরণই উঠে আসবে বলে মত এসএসকেএমের মেডিসিন বিভাগের প্রধান চিকিৎসক সৌমিত্র ঘোষের। তিনি বলেন, ‘‘সব চলে গিয়েছে ভেবে এক শ্রেণির মানুষ হুল্লোড়ে মাতছেন। তাতেই যা ক্ষতি হওয়ার, হচ্ছে। অনেকেই বিভিন্ন স্ট্রেনের যুক্তি দিচ্ছেন। কিন্তু মাস্ক পরলে সবই আটকানো সম্ভব। দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা যে ভাবে বাড়ছে, তাতে এক মাস পরে হয়তো ফের একমাত্র আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াবে করোনাই।’’ চিকিৎসকদের আশঙ্কা, কলকাতা, হাওড়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এখনও ভোট হয়নি। যত দিন এগিয়ে
আসবে, ওই সব জায়গায় রাজনৈতিক কর্মসূচি বাড়বে। পাল্লা দিয়ে উধাও হবে করোনা-বিধিও।
আগে ১০০ জনের মধ্যে অন্তত ৭০ জন মাস্ক পরলেও, এখন সেই সংখ্যা ৫-৭ জনে নেমেছে। নাগরিকদের একাংশের এই আচরণই কলকাতা ও তিন জেলায় করোনার লেখচিত্রকে ঊর্ধ্বমুখী করেছে বলে জানাচ্ছেন পালমোনোলজিস্ট অনির্বাণ নিয়োগী। তিনি বলেন, ‘‘রাজ্যে এখন একটাই আগ্রহ, ভোট। যাঁরা ভোটের সঙ্গে জড়িত, তাঁরা তো নিয়ম ভাঙছেনই। সঙ্গে জুটিয়ে নিচ্ছেন সাধারণ লোকজনকেও। অতিমারি সর্বাধিক দুই কিংবা তিন বছর থাকতে পারে। তাতে দ্বিতীয় ঢেউ আসবেই। অন্য রাজ্য থেকে বঙ্গে লোকজন আসা বন্ধ করা হয়নি। যথারীতি হাসপাতালে করোনা রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে।’’
তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে করোনার সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও, আচমকা অত্যধিক গরম পড়ায় অনেকেই মাস্ক খুলে রাখছেন। এর ফলে সংক্রমণ ছড়ানোর সুযোগ বেশি মাত্রায় তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছেন সংক্রামক রোগ চিকিৎসক যোগীরাজ রায়। তিনি বলছেন, ‘‘যাঁরা অত্যধিক কায়িক পরিশ্রম করেন, তাঁরা অনেকেই কষ্ট হচ্ছে বলে মাস্ক খুলে রাখছেন। এ ছাড়াও ব্রিগেডে মিটিং হয়েছে। সেখানে দূরত্ব-বিধি না মেনে মেলামেশা হয়েছে। এ সবের কারণেই বেশি মাত্রায় সংক্রমণ ছড়াচ্ছে।’’
তবে দৈনিক মৃতের সংখ্যা কম দেখে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কারণ নেই বলেও জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। যোগীরাজের কথায়, ‘‘আক্রান্তের সংখ্যা শেষ ৭-১০ দিনে বাড়তে শুরু করেছে। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তো কেউ মারা যান না। প্রায় ১৫-২০ দিন পরে মৃত্যু ঘটে। তাই মৃত্যুর হার নিয়ে এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়।’’