অমিত মজুমদার, পেশায় একটি রেস্তরাঁর ম্যানেজার। গোলপার্ক এলাকার বাসিন্দা। ২৬ জুলাই রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ তাঁর কাছে মেসেজ আসে। তিনি বলেন, “প্রথমে দেখলাম ১০ হাজার টাকা ডেবিট হয়েছে। মেসেজটা পেয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক মিনিটের মধ্যে পর পর দু’বারে কুড়ি হাজার টাকা উঠে গেল। মোট ৩০ হাজার টাকা।”
পরের দিন ব্যাঙ্কে অভিযোগ জানাতে গিয়ে তিনি দেখেন, নতুন দিল্লির কালকাজি এলাকার একটি এটিএম থেকে তাঁর টাকা উঠেছে। তাঁর ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট অনুযায়ী, ২৪ জুলাই তিনি শেষ নিজে টাকা তুলেছিলেন। কানাড়া ব্যাঙ্কের গড়িয়াহাট ব্রাঞ্চের পাশে একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের এটিএম থেকে।
অনিন্দিতা বসাক, তিনিও অমিতবাবুর মতোই প্রতারিত। ২৯ জুলাই তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে ১৪ হাজার টাকা তোলা হয়। একই ভাবে নতুন দিল্লির একটি এটিএম থেকে। অমিত মজুমদারের মতোই তিনিও ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চের পাশে একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের এটিএম থেকে টাকা তোলেন। তিনি বলেন, “অনেক সময় কানাড়া ব্যাঙ্কের ই-লাউঞ্জ কাজ করে না। তাই পাশের দু’টি বেসরকারি ব্যাঙ্কের এটিএম ভরসা।”
আরও পড়ুন: কলকাতার বহু ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে দু’দিনে লক্ষ লক্ষ টাকা গায়েব!
শুধু এই দু’জনই নন। প্রতারিত গ্রাহকদের অধিকাংশই এই এটিএম গুলি থেকেই টাকা তুলেছেন সম্প্রতি। আর সেখান থেকেই তদন্তকারীদের ধারণা, জালিয়াতরা স্কিমিং মেশিন লাগিয়েছে এই এটিএম গুলিতেই। যে সব গ্রাহক প্রতারিত হয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই ব্যাঙ্ক থেকে টাকা উঠেছে সর্বাধিক ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। কারণ, সাধারণ ভাবে একটি কার্ডে এর বেশি পরিমাণ টাকা এটিএম থেকে এক দিনে তোলা যায় না।
কিন্তু কী ভাবে এই জালিয়াতি চলে?
সাইবার বিশেষজ্ঞরা একে বলেন স্কিমিং বা ক্লোনিং। সাইবার বিশেষজ্ঞ সুশোভন মুখোপাধ্যায় ব্যাখ্যা করেন, দু’টি পদ্ধতিতে এই স্কিমিং হয়।
প্রথমত, কার্ডের তথ্য চুরি করার একটি বিশেষ যন্ত্র থাকে। সেই যন্ত্র আকারে তিন ইঞ্চির থেকে বড় নয়। এটিএমে কার্ড সোয়াইপের জায়গায় সহজেই সেই যন্ত্র লুকিয়ে রাখা যায়। কোনও গ্রাহক কার্ড সোয়াইপ করা মাত্রই দুষ্কৃতীদের লাগানো যন্ত্রে সেই তথ্য বা ডেটা নকল করে নেওয়া হয়। পরে দুষ্কৃতীদের কাছে সেই তথ্য পৌঁছন মাত্রই সেই তথ্যের ভিত্তিতে নতুন কার্ড তৈরি হয়ে যায়।
প্রশ্ন, কার্ড না হয় তৈরি হল। কিন্তু এটিএমের পিন কোড কী করে পাচ্ছে জালিয়াতরা?
এটিএম জালিয়াতি রোধের দায়িত্বে থাকা একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের এক আধিকারিক বলেন, এর আগে একাধিক জালিয়াতির ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, জালিয়াতরা এটিএমে লাগানো ক্যামেরার ‘সেটিংস’ পরিবর্তন করে দেয়। তার ফলে কোনও গ্রাহক যখন পিন নম্বর টিপছেন, সেটা দেখা যায় সেই সিসি ক্যামেরায়।
কলকাতা পুলিশের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘অনেক সময় দেখা যায়, এটিএমের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা কর্মীদের একাংশ এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। তাঁদের প্রত্যক্ষ মদতেই এই জালিয়াতি করার সুযোগ পায় দুষ্কৃতীরা।’’
আরও পড়ুন: তান্ত্রিকের পরামর্শে কিশোরীর গলায় ৯টি সূচ! বাঁচালেন চিকিৎসকেরা
কানাড়া ব্যাঙ্কের তদন্তকারীদের দাবি, প্রাথমিক তদন্তের শেষে এই স্কিমিংয়ের আশঙ্কাই প্রবল। তবে, সাইবার বিশেষজ্ঞ সুশোভনবাবু এই জালিয়াতির জন্য দায়ী করেছেন ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকেই। তিনি বলেন, “এই ধরনের জালিয়াতি বেশি হয় যে সমস্ত এটিএম কিয়স্কে, সেখানে কোনও নিরাপত্তারক্ষী থাকেন না।” কানাড়া ব্যাঙ্কের এই ই-লাউঞ্জেও কোনও নিরাপত্তারক্ষী নেই।
আর সেই কারণেই তদন্তকারীরা কানাড়া ব্যাঙ্কের এটিএম, সঙ্গে পাশে থাকা বাকি দু’টি বেসরকারি ব্যাঙ্কের এটিএমের গত কয়েক দিনের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করছেন। যাতে কারা এই স্কিমিং ডিভাইস লাগিয়েছিল তা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। অন্য দিকে নতুন দিল্লির সেই এটিএমেরও ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে, কারা ওই টাকা তুলেছে তা চিহ্নিত করতে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এটিএম রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানির কর্মীদেরও।