স্টিয়ারিং হাতে প্রতিমা। নিজস্ব চিত্র।
হাতা আছে, খুন্তি আছে। আর আছে স্টিয়ারিং!
বাড়ির বাকিরা যখন রাঁধেন-বাড়েন, প্রতিমা তখন বাস চালান। বেলঘরিয়া নিমতার প্রতিমা পোদ্দার। কলকাতা মহানগরীর মহিলা বাসচালক। অভাবের সংসারে দুর্গা প্রতিমা হয়ে উঠে যিনি দশ হাতে সামলে রাখেন ঘরকন্না থেকে রুজি-রোজগার।
স্বামী শিবেশ্বর পোদ্দার নিজেও ছিলেন বাসচালক। এক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বাস চালানোর রুজি বন্ধ হতে বসেছিল প্রায়। যৌথ পরিবারে দশ বছরের সংসারে আচমকাই তখন বিপর্যয়। প্রতিমা-শিবেশ্বরের দুই মেয়েই সে সময়ে একেবারে ছোট। একজন নয়, অন্যজন সবে দু’বছরের। তাদের পড়াশোনার পথও বন্ধ হওয়ার মুখে।
এই অবস্থাতেই হাল ধরলেন প্রতিমা। কিন্তু রোজগার করবেন কী ভাবে? মূলত স্বামীর উৎসাহ আর জোরাজুরিতেই গাড়ি চালানো শেখা শুরু। প্রথমটায় কিছু দিন সল্টলেকে অ্যাম্বুল্যান্স চালানো। তার পরে এক দিন প্রতিমা দেখলেন, বাস চালানোটাই বরং সহজ হবে তাঁর পক্ষে। স্টিয়ারিং তার চেনা। বাড়ির কাছে বাস স্ট্যান্ড। ছোটবেলা থেকেই কাকা, ভাই এবং পরে স্বামী, দেওরদের সূত্রে গাড়ি চালানো বা বাসচালক-যাত্রী-কন্ডাক্টরের দুনিয়াটাও পরিচিত। এমনকি, কতক্ষণ চালাবেন, কতটা সময় বাড়িতে দেবেন, সেটাও থাকবে নিজের হাতেই।
আরও পড়ুন: আমার ভেতরের নারীকে গড়া আজও শেষ হয়নি
আরও পড়ুন: কমলার পিএইচডি আবেদন খারিজ করেছিলেন সি ভি রমন!
অতএব আর বেশি ভাবেননি বছর তিরিশের প্রতিমা। নিমতা-হাওড়ার মিনিবাসে চালকের আসনে উঠে বসেছেন সোজা। স্বামী তো বটেই, পাশে পেয়েছেন শাশুড়ি-ননদকেও। সেই ২০০৬ সাল থেকে এই ২০২০-তে মাঝবয়সে পৌঁছেও মিনিবাস নিয়ে দাপটে শহর ঘুরছেন মহানগরীর ‘ড্রাইভার দিদি’।
স্বামী শিবেশ্বর পোদ্দারের সঙ্গে প্রতিমা। নিজস্ব চিত্র।
প্রায় রাত থাকতে থাকতেই বেরিয়ে পড়া। ঘণ্টা চার-পাঁচ পরে বাড়ি ফিরে সংসারের দেখভাল। মেয়েদের বড় করার যাবতীয় দায়িত্ব সামলান নিজের হাতে। এর পরে ফের দ্বিতীয় দফায় বাসে ফেরা এবং রাত পর্যন্ত নিরন্তর ডিউটি। দুর্ঘটনার জের সামলে উঠে স্বামী শিবেশ্বর এখন স্ত্রীর বাসেই কন্ডাক্টরের ভূমিকায়। মাঝের সময়টুকুতে স্টিয়ারিঙের ভারও নেন তিনিই। আর স্বামীকে পাশে পেয়ে প্রতিমারও বল-ভরসা বেড়ে যায় অনেকখানি। শুধু তা-ই নয়। রাতের পথে বাস না পেয়ে অসহায় মানুষ কিংবা বয়স্ক যাত্রীদের কাছ থেকে জুটে যায় প্রশংসা, উৎসাহ, আশীর্বাদ, সম্মান তো বটেই। আর দুই মেয়ে, শাশুড়ি, ননদের কাছ থেকে আসে সাধ্যমতো সাহায্য।
তবে ১৪ বছরের বাস-সফরের দিনগুলোর সবটুকুই এমন সরলরেখায় চলেনি। যৌথ পরিবারের বাকিদের থেকে এসেছে ব্যঙ্গ, গঞ্জনা। প্রতিবেশীরাও ছুড়ে দিয়েছেন তীর্যক মন্তব্য। কখনও মিলেছে পরিবারের কলঙ্ক হয়ে ওঠার বদনাম। কেউ বা প্রশ্ন তুলেছেন, বাস চালানো ছাড়া আর কি কোনও কাজ ছিল না? বহু যাত্রীও চালকের আসনে তাঁকে দেখে বাসে উঠতে চাননি। কোনওটাই গায়ে মাখেননি প্রতিমা। উপায়ও ছিল না। স্বামীর দুর্ঘটনার পরে দুই মেয়ে, অসুস্থ শাশুড়িকে নিয়ে অথৈ জলে পড়া সংসারটাকে দশভুজা হয়ে আগলে রাখতে হতো তাঁকেই।
সময় পাল্টেছে আস্তে আস্তে। স্বামী সামলে উঠেছেন খানিকটা। মেয়েরাও বড় হয়ে এক জন ক্লাস টেন, অন্য জন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া। পরিবারের শ্রী ফিরছে একটু একটু করে। আর কলকাতার মহিলা বাসচালকের পরিচিতিও বেড়েছে ক্রমশ। প্রতিমার ঝুলিতে এখন প্রচারের আলো, স্বীকৃতি, সম্মান- সবই।
স্বামী ভালবেসে গান শোনান স্ত্রীকে। সে গান প্রতিমার বড্ড পছন্দের। আর ভালবাসেন কবিতা। রবি ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কিংবা ‘হাট’ দিব্যি শুনিয়েও দিতে পারেন যখন খুশি। তবে কখন যেন স্টিয়ারিঙটাই হয়ে গিয়েছে ভালবাসার কেন্দ্রবিন্দু।
প্রতিমা তাই ছুটে চলেছেন বাস নিয়ে। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত। ঝড়ের গতিতে। অ-নে-ক-টা পথ।