অবাধ: বহাল তবিয়তে চলছে নিষিদ্ধ প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার। শুক্রবার, জানবাজারে। নিজস্ব চিত্র
গত বছরই কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেছিল আগামী দু’বছরের মধ্যে ধাপে ধাপে এক বার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্য বন্ধের কথা। সেই প্লাস্টিক ব্যাগ বন্ধের জন্য আইন রয়েছে এ রাজ্যেও। তবে সে আইন রয়েছে নামেই। তার মধ্যেই দিব্যি লুকিয়ে-চুরিয়ে নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ব্যাগের ব্যবহার চলছে। শুক্রবার, আন্তর্জাতিক প্লাস্টিক ব্যাগমুক্ত দিবসেও (ইন্টারন্যাশনাল প্লাস্টিক ব্যাগ-ফ্রি ডে) যা নিয়ে চিন্তিত বিশেষজ্ঞেরা। কারণ, এ দিনও শহরের বিভিন্ন জায়গায় নিষিদ্ধ প্লাস্টিক ব্যাগের অবাধ ব্যবহার চোখে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্লাস্টিক পচনশীল নয়। তাই মাটিতেই থেকে যায়। এমনকি, প্লাস্টিকের ব্যাগ, পাত্র-সহ নানা উপকরণ হাজার বছর ধরেও মাটিতে জমে থাকতে পারে। যা মাটি ও জলদূষণের অন্যতম কারণ। বিশেষজ্ঞদের একাংশ জানাচ্ছেন, শুধু মাটি ও জলের দূষণই নয়, গাছের পক্ষেও ক্ষতিকারক প্লাস্টিক বর্জ্য।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর রত্না দত্তের কথায়, ‘‘মাটির গুণমান নষ্ট করে দেয় প্লাস্টিক। সেই সঙ্গে গাছেরও ক্ষতি করে। কারণ, শিকড়ের মাধ্যমে গাছ জলের পাশাপাশি পুষ্টিও সংগ্রহ করে।’’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিমার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক সমিতকুমার রায় তথ্য দিয়ে জানাচ্ছেন, সারা দেশে প্রতি বছর প্রায় ৯৪০ কোটি কিলোগ্রাম প্লাস্টিক-বর্জ্য উৎপন্ন হয়! যার ৪০ শতাংশ প্লাস্টিক অসংগৃহীত অবস্থায় থাকে। গত ৭০ বছরে অর্থাৎ ১৯৫০ সাল থেকে সারা বিশ্বে প্রায় ৮৩০ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে। যার ৬০ শতাংশ অর্থাৎ ৪৯৮ কোটি টন প্লাস্টিকই মাটি ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশে অপচনশীল বর্জ্য হিসেবে রয়ে গিয়েছে! সমিতবাবুর কথায়, ‘‘এক বার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের কারণে প্লাস্টিক-বর্জ্যের পরিমাণ আরও অনেকটাই বেড়ে যেতে পারে।’’
অথচ প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই রাজ্য সরকারের তরফে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতি সংক্রান্ত একটি রিপোর্টে রাজ্য পুর ও নগরোন্নয়ন দফতর দেশের ৬০টি শহরে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এবং সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব প্লাস্টিকস ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (সিআইপিইটি), আহমেদাবাদের যৌথ গবেষণার উল্লেখ করেছে। যেখানে দেখা গিয়েছে, বিভিন্ন রাজ্যের স্থানীয় পুর এলাকার মোট বর্জ্যের মধ্যে প্লাস্টিকের পরিমাণ ৩.১০-১২.৪৭ শতাংশ। পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের তরফেও কয়েকটি পুরসভাকে ক্লাস্টারে ভাগ করে একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। দেখা গিয়েছে, উত্তর দমদম, দক্ষিণ দমদম, দমদম ও বরাহনগর পুরসভার দৈনিক মোট বর্জ্যের মধ্যে প্লাস্টিকের পরিমাণ যথাক্রমে ৬.৩, ১.৬, ১.৫ এবং ৪ শতাংশ। অশোকনগর-হাবড়ার ক্ষেত্রে ওই পরিমাণ যথাক্রমে ১১.৫ এবং ১৩.৯ শতাংশ। জলপাইগুড়ি, নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগর, শান্তিপুরে তা হল যথাক্রমে ১৯.৬, ২৫.৪, ২৭.৮ এবং ১৮.৩ শতাংশ।
নগরোন্নয়ন দফতরের কর্তাদের কয়েক জন জানাচ্ছেন, নিষিদ্ধ প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহারে কলকাতাবাসী কতটা সচেতন, তা জানতে আরও একটি সমীক্ষায় ৩১০ জন বিক্রেতা এবং ৬৩০ জন ক্রেতা, অর্থাৎ সব মিলিয়ে মোট ৯৪০ জনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ১৬৭ জন বিক্রেতা (৫৪ শতাংশ) এবং ৩৬৫ জন ক্রেতাই (৫৮ শতাংশ) জানিয়েছিলেন, তাঁরা ৪০ মাইক্রনের কম পুরু প্লাস্টিকের ব্যাগই ব্যবহার করেন। এ ছাড়া প্লাস্টিকের তৈরি বোতল, ক্যাপ, খাবারের প্যাকেট, বাজারের ব্যাগ, স্ট্র-সহ অন্য উপকরণও রয়েছে, যেগুলির গন্তব্য মাটি-ই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক রঞ্জনা চৌধুরী বলেন, ‘‘প্লাস্টিক যে উপাদানে তৈরি, সেগুলি শুধু মানুষ কেন, প্রাণীর শরীরের পক্ষেও ক্ষতিকারক, কার্সিনোজেনিক। তাই প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ অবশ্যই প্রয়োজন।’’
তা সত্ত্বেও প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার চলছেই। এই পরিস্থিতিতে যে সমস্ত বেআইনি কারখানা অবৈধ ভাবে এই প্লাস্টিকের ব্যাগ উৎপাদন করে তা বাজারে সরবরাহ করছে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। শুক্রবার পরিবেশমন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র বলেন, ‘‘কিছু অবৈধ ছোট কারখানা আছে, যারা নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ব্যাগ তৈরি করে বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে। লকডাউনের সময়ে আমরা পর্যাপ্ত নজরদারি চালাতে পারিনি। সেই সুযোগ ওই অবৈধ উৎপাদনকারীরা নিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে এ বার সেগুলির বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ করে বন্ধের চেষ্টা করব।’’