উচ্ছ্বাস: খেলার আগেই বৃদ্ধাশ্রমে আর্জেন্টিনা সমর্থকদের উৎসব। শনিবার, কসবায়। ছবি: সুমন বল্লভ
‘...কোথাও আমার মনের খবর পেলাম না!’ ‘জীবনপুরের’ ওই ‘পথিক’দের মনের খবর বোধ হয় সত্যিই কেউ জানেন না। হয়তো তিনি নিজেও জানতে চান না। কিন্তু শহর যখন বিশ্বকাপ জ্বরে কাঁপছে ঘোলাটে চোখগুলি তখন জানাচ্ছেন, ‘আমরা মেসিভক্ত।’
শনিবার তাঁদের জন্যই কসবা নারকেলবাগানে বড় লোহার গেট, প্রাচীর ঘেরা বৃদ্ধাশ্রমের বারান্দাকেই এক টুকরো আর্জেন্টিনার সাজে সাজিয়ে তুলেছিলেন বাঙুর অ্যাভিনিউয়ের বাসিন্দা দম্পতি মহেন্দ্র অগ্রবাল ও রেশমীদেবীর সংগঠন।
সকালে চিয়ার গার্লদের নাচ, কেক কাটা, মেসি-মারাদোনার নাম করে উল্লাস আর বিকেলে আকাশি-সাদা জামা পরে বড় স্ক্রিনে ‘ধন্যি মেয়ে’ দেখার মাঝেই বিরতিতে বসেছিল আড্ডা, গানের আসর। সেখানেই অনুষ্ঠানের এক পরিচালক দীপান্বিতা বাগচীকে ধরে ‘জীবনপুরের পথিক রে ভাই’ গান শোনাচ্ছিলেন মারাদোনার ভক্ত ৮০ বছরের বৃদ্ধা। তিনি বললেন, ‘‘জানো, ছেলের পাশে বসে খেলা দেখতাম। ওই অকালে চলে গেল।’’
বৈকালিক আড্ডা অবশ্য বেশি ক্ষণ চালাতে নারাজ জহর সেনগুপ্ত, বিজয় গুপ্তেরা। খানিক পরেই যেখানে মাঠে নামবেন প্রিয় মেসি। তার আগে পুরনো খেলা নিয়ে চর্চার প্রয়োজন বলেই মত বৃদ্ধ আবাসিকদের একাংশের। অশীতিপর বিজয়বাবুর কথায়, ‘‘এ বারে নাইজিরিয়ার বিরুদ্ধে মেসির গোলটাই এখনও সেরা।’’
শুধু আর্জেন্টিনাই নয়, বৃদ্ধের পছন্দে রয়েছে স্পেনও। মনের ইচ্ছে বিশ্বকাপ ছিনিয়ে নেবে কোনও একটি দল। তবে মনের কোণে জমে থাকা ইচ্ছাগুলি এখন তা আর মনে করতে চান না বিজয়বাবু। যদিও স্মৃতির পাতা কিছুটা উল্টোতেই উঠে এল ‘বুলান’। একমাত্র ছেলেকে কোলে নিয়ে মারাদোনার গোল দেখার কথা ভাবতেই চোখটা চিকচিক করে উঠল বিজয়বাবুর। তিনি বললেন, ‘‘জীবনের খেলায় অনেক গোল খেয়ে গেলাম।’’
অনেক গোল খেয়েও নিঃসঙ্গ জীবনে বিশ্বকাপের সময়ে নিজেকে সুখী মনে করেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রাক্তন প্যাথলজিস্ট সমরেন্দ্রনাথ কর। সকাল থেকেই আকাশি-সাদা জামা গায়ে বসে স্ক্রিনের সামনে চেয়ারে। দুই মেয়ে আর আয়কর ভবনে কর্মরত স্ত্রীকে নিয়ে ভরা সংসার ছিল ‘ডাক্তারবাবুর’। বিশ্বকাপের সময়ে গাড়ি হাঁকিয়ে বাড়ি ফিরে বসে পড়তেন টিভির সামনে। রাত জেগে দেখতেন খেলা। আজকাল অবশ্য বৃদ্ধাশ্রমের বহু আবাসিকের মতোই স্মৃতি অনেক সময়েই সঙ্গ দেয় না তাঁর। কিছুটা এগিয়ে থমকে বলেন, ‘‘বেশ তো আছি। এখন ভাবনায় শুধু আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল।’’
মাঝেমধ্যে পুরনো স্মৃতিই এখন বর্তমান সান্ত্বনা দাশগুপ্তের। এ কথা-সে কথার মাঝেই হাতে ধরা লাঠিটা শক্ত করে ধরে বলেন, ‘‘আমার ছেলে কিন্তু পড়াশোনা করে তবেই খেলা দেখত।’’ পড়া ছেড়ে ছেলেদের খেলা দেখতে দিতে নারাজ ছিলেন বাঘা যতীনের কল্পনা ঘোষ। ছেলেদের কাছেই জেনেছিলেন আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, ব্রাজিলের নাম। তিনি বলেন, ‘‘সে সব এখন অতীত।’’
ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে ৭টা। মাঠে নামল আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স। ‘সবাই থামুন। এ বার শুধু খেলা’— বলে উঠলেন ফুটবল পাগল জহরবাবু।
বল নিয়ে গোল দিতে দৌড়চ্ছেন মেসি। উচ্ছ্বাসের আওয়াজে ক্রমশ চাপা পড়ছে ওঁদের ‘মনের খবর’।
বদলে ভেসে আসছে ‘আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।’