এ দেশের স্কুলের বাচ্চাদের জীবনেও এমন কাউন্সেলরের গুরুত্ব বাড়ছে। প্রতীকী ছবি।
জনপ্রিয় আমেরিকান ওয়েব-ধারাবাহিক ‘নেভার হ্যাভ আই এভার’-এর দেবী, থুড়ি ডেভিকে চেনেন এ দেশের অনেকেই। নেট-কাহিনির মুখ্য চরিত্র আমেরিকার স্কুলপড়ুয়া তামিল বংশোদ্ভূত মেয়েটি অকালে বাবাকে হারিয়েছে। সেই শোকের ধাক্কায় টানাপড়েনের মধ্যেই তার এগিয়ে চলার আখ্যানে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, তার স্কুল-নিযুক্ত মনস্তত্ত্ববিদ বা ‘কাউন্সেলর’। তাঁকে ডেভি মন খুলে সব কথা বলতে পারে। তিনি ডেভির দোষ-গুণ ধরে খোঁটা দেন না। মাকে লুকিয়ে ডেভি কী করছে, কোন ছেলেটিকে ভাল লাগছে, কী ভুল করছে, সবই কাউন্সেলর মহিলাকে গলগল করে সে বলে চলে। অনেক সময়ে চিত্রনাট্যের গল্পও সেই কথাবার্তার ফাঁকেই খুলতে থাকে।
এ দেশের স্কুলের বাচ্চাদের জীবনেও এমন কাউন্সেলরের গুরুত্ব বাড়ছে। প্রবীণ স্কুলশিক্ষিকা ও স্কুল প্রশাসক দেবী কর বলছিলেন, “আগেকার দিনে বাচ্চারা মা-বাবাকে সব কথা বলতে না-পারলেও কোনও কাকিমা, পিসি বা তুতো দাদা-দিদিদের প্রাণের সব কথা বলতে পারত! এখন অনেকের জন্য সেই রাস্তাটাও বন্ধ। অগত্যা স্কুল কাউন্সেলরই ভরসা।”
মুক্তি-আসন্ন একটি বাংলা ছবি ‘আকরিক’ও আজকের শিকড়হীন শৈশব বা সম্পর্কের চেহারাটা মেলে ধরছে। বিখ্যাত এক লেখিকার বছর দশেকের ছেলে মায়ের কাছেই বড় হচ্ছে। সে জানে, মা-বাবা বিবাহবিচ্ছিন্ন। আত্মীয়স্বজন বলতেও তার কোনও ধারণা নেই। পাহাড়ে মায়ের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে একা-একা ব্যাটবল খেলার ফাঁকে জনৈক ‘দাদু’র সঙ্গে তার পরিচয় ঘটছে। দাদুটির পুত্রও আমেরিকা-প্রবাসী। দীর্ঘদিন মা, বাবার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই। দাদুর রক্তের সম্পর্কের নাতি থেকেও নেই। অনাত্মীয় এই শিশু ও বৃদ্ধের বন্ধুত্বে সমাজের একটি বিশেষ দিক উন্মোচিত হচ্ছে। তথাগত ভট্টাচার্যের ছবি ‘আকরিক’ আমাদের সমাজের নিঃসঙ্গ শৈশব ও বার্ধক্যের নিষ্ঠুর বাস্তবতার কথা বলে অকপটে। পাতানো দাদু-নাতি ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় ও অঙ্কনের কথাবার্তায় ধরা পড়ে, ছোট ছেলেটি ভাইফোঁটা, দেওয়ালি কাকে বলে, জানে না! পরিবারের সকলের একসঙ্গে উৎসবে মেতে ওঠা নিয়ে কোনও ধারণাই তার নেই। ছবিতে শিশুটির মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত।
এই ছবিতে ভিক্টরের সদা ব্যস্ত, প্রতিষ্ঠিত, প্রবাসী ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করা সুপ্রতিম রায় ব্যক্তিগত জীবনে কলকাতার একটি সাবেক বড় বাড়ির ছেলে। হাতিবাগান, কলুটোলার রায় বাড়িতে আশৈশব দোল, দুর্গোৎসব দেখেছেন। সুপ্রতিম বলছেন, “আমি নিজে একেবারে ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছিলাম। সেই ক্ষত থাকলেও কাকা, জেঠামশাই, পিসেমশাই, কাকিমা, পিসিমারা আগলেই রাখতেন।” তবে, যৌথ পরিবার মানেই দারুণ সুরক্ষার ঘেরাটোপ অথবা একলা মা-বাবারা সন্তানকে সর্বদাই সাহচর্য দিতে ব্যর্থ— এটাও বলা যায় না। মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায় মানছেন, আজকের বাচ্চাদের কাউন্সেলর-নির্ভরতার কথা। তবে তাঁর কথায়, “পারিবারিক কিছু সম্পর্ক, তুতো দাদা, কাকা, পিসি, বৌদিরা না-থাকাও অবশ্যই কষ্টের। আবার অনাত্মীয় কারও সঙ্গেও রক্তের সম্পর্কের মতো নৈকট্য গড়ে উঠতে পারে।” ‘আকরিক’ ছবির পাতানো দাদু, নাতির গল্পে যা দেখা যাচ্ছে।