গঙ্গা থেকে প্রতিমার কাঠামো তুলছে ক্রেন। শুক্রবার, বাবুঘাটে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী, সুদীপ ঘোষ
এ শহরে গঙ্গায় ভাসান হওয়া দুর্গাপুজোর সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। স্বাভাবিক ভাবেই অসুর, সিংহ এবং দুর্গার সন্তান-সহ কাঠামোর সংখ্যা আরও বেশি। ৪০ হাজারের মতো। বিপুল সংখ্যক কাঠামোর জন্য কি বিকল্প জলাশয় করা সম্ভব? নাকি ডাঙাতেই ভাসানের আয়োজন করতে হবে? আপাতত সেই আলোচনায় সরগরম পরিবেশবিদেরা।
কারণ, ‘ন্যাশনাল মিশন ফর ক্লিন গঙ্গা’ (এনএমসিজি) সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ-সহ ১১টি রাজ্যকে একটি চিঠি পাঠিয়ে গঙ্গাও তার শাখা-প্রশাখায় ভাসান দেওয়ার রীতি বন্ধ করতে বলেছে। সেই সঙ্গে তাদের নিদান, ওই নদীগুলির পাশে কোনও অস্থায়ী জলাশয় তৈরি করে সেখানে ভাসানের ব্যবস্থা করা হোক। জলাশয়ে একটি সিন্থেটিক লাইনার রাখা হবে, যেখানে ভাসানের বর্জ্য জমা হবে। ভাসানের পরে তা সরিয়ে ফেলা হবে। অবশ্য জাতীয় পরিবেশ আদালত সূত্রের খবর, ভাসানের জন্য এনএমসিজি যে নিদান দিয়েছে, তা তারা আগেই উল্লেখ করেছিল। ২০১৭ সালেই একটি মামলার প্রেক্ষিতে পরিবেশ আদালত নদীর ধারে ওই কৃত্রিম জলাশয় তৈরির কথা বলেছিল। যদিও দু’বছর পরেও তা মানা হয়নি।
এ দিকে এ বছর থেকে যমুনায় ভাসান পুরোপুরি বন্ধ করা গিয়েছে। এ জন্য ভাসানের কৃত্রিম জায়গা তৈরি করা হয়েছিল। সেখানেই ভাসান দিতে হয়েছে ক্লাবগুলিকে। নজর এড়িয়ে কোনও ক্লাব যাতে যমুনায় ভাসান দিতে না পারে, তাই প্রত্যেকটি ঘাটে যাওয়ার রাস্তায় ব্যারিকেড করে দেওয়া হয়েছিল। ছিল পুলিশ প্রশাসনের কড়া নজরদারিও। তবে পরিবেশবিদদের অনেকেরই বক্তব্য, অন্য রাজ্যে বিকল্প জলাশয়ের ব্যবস্থা করা গেলেও কলকাতায় তা করা প্রায় অসম্ভব। কারণ, এত সংখ্যক দুর্গাপুজো অন্য কোথাও হয় না। দ্বিতীয়ত, গঙ্গার পাড়ে সে রকম জায়গাও নেই যেখানে অস্থায়ী জলাশয় বা পুকুর তৈরি করা যায়। ফলে পরিবেশবিদদের আলোচনায় গঙ্গায় ভাসানের পরিবর্তে নানা বিকল্প ব্যবস্থার কথা উঠে আসছে।
বারাসতের একটি পুকুরের জলে ভাসছে প্রতিমার কাঠামো। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী, সুদীপ ঘোষ
যেমন ২০১৭ সালে জাতীয় পরিবেশ আদালতে নদী, জলাশয়ে ভাসান নিয়ে একটি মামলায় বিকল্প ব্যবস্থার কথা উঠে এসেছিল। ওই বিকল্প ব্যবস্থায় বলা হয়েছিল, ভাসানের জন্য কোনও একটি নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেতে পারে। সেই প্ল্যাটফর্মেই প্রতিমা বসিয়ে জল ছিটিয়ে গলিয়ে ফেলা হবে। প্ল্যাটফর্মের নীচে একটি পাইপ থাকবে যার সঙ্গে একটি বড় কৃত্রিম জলাধারের সংযোগ করা থাকবে। ওই পাইপের মাধ্যমে মাটি ধোয়া জল নীচের জলাধারে জমা হবে। তার পরে সেই জলই পাম্পের সাহায্যে ফের প্রতিমা গলাতে ব্যবহার করা হবে। কেন্দ্রীয় জ্বালানি গবেষণা সংস্থার অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী তথা ওই মামলার আবেদনকারী অম্বরনাথ সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘গঙ্গা দূষণ যে করেই হোক রুখতে হবে। তাই বিকল্প ব্যবস্থা দ্রুত কার্যকর করতেই হবে।’’
পরিবেশকর্মীদের বড় অংশের আবার বক্তব্য, পুকুর খনন, ভাসানের ব্যবস্থা-সহ অনেক খরচ রয়েছে। সব থেকে বড় সমস্যা জায়গার। পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের কথায়, ‘‘সব প্রতিমা রাখা যাবে এমন বিকল্প জায়গার কথা ভাবা যেতেই পারে। এমনিতে প্রতিমা তৈরির উপাদানগুলি পচনশীল। সে সব মাটিতেই মিশে যাবে।’’ যদিও এ ক্ষেত্রে মাটির মাধ্যমে দূষণ ছড়াবে কি না, তা নিয়ে নিশ্চিত নন কেউই।
পরিবেশকর্মীদের অনেকেই আরও একটি বিষয়ের উপরে গুরুত্ব দিচ্ছেন। তা হল ভাসানের বিকেন্দ্রীকরণ। কেন স্থানীয় ভাবে ভাসানের ব্যবস্থা করা হবে না, সে প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। এক পরিবেশকর্মীর কথায়,
‘‘কার্নিভালের কারণে বড় পুজো উদ্যোক্তারা গঙ্গায় আসেন। দক্ষিণ কলকাতা থেকেও অনেক পুজো উদ্যোক্তা গঙ্গাতেই ভাসান দেন। কিন্তু পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে স্থানীয় ভাবে ভাসানের দিকে জোর দিতে হবে। সেখানে বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে।’’ অন্য এক পরিবেশকর্মীর কথায়, ‘‘পাড়ার ক্লাবগুলিকে রাজ্য সরকার যে টাকা দেয় তারই একটি অংশ বরাদ্দ রাখা হোক পরিবেশবান্ধব ভাসানের জন্য। তা হলে উৎসবও হবে, পরিবেশও বাঁচবে।’’
ফলে ভাসানে কি গঙ্গাই গতি, না কি পরিবেশবান্ধব বিকল্প কোনও ব্যবস্থা উঠে আসবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।