পলাশির যুদ্ধ জিতে ইংরেজরা বণিক থেকে রাজা হল। কিন্তু যে দেশটা শাসন করতে হবে, ব্যবসা করতে হবে, রাজস্ব আদায় করতে হবে, একের পর এক রাজ্য দখল করতে হবে, তার কোথায় কী আছে সেটাই তো জানা নেই। এ কাজে ফাঁকি চলবে না, পথঘাট জঙ্গল-পাহাড়ের ঠিকঠাক হদিস জানা না থাকলে যুদ্ধ জেতা সহজ নয়, সব জায়গায় তো আর ষড়যন্ত্র হবে না! এ বার মানচিত্র বানাতে হবে। সে জন্য সরেজমিনে জরিপ করা দরকার। কে করবে সেই জরিপ?
পলাশির যুদ্ধের মাত্র দশ বছর পরেই বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি জরিপের জন্য জেমস রেনেলকে সার্ভেয়ার জেনারেল পদে নিযুক্ত করল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। আর এই সময় থেকেই সার্ভে অব ইন্ডিয়া-র সূচনা ধরা হয়। রেনেল কী ভাবে তাঁর বেঙ্গল অ্যাটলাস (১৭৮০) তৈরি করেছিলেন, সে এক রোমাঞ্চকর গল্প। কিন্তু ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম ল্যামটন-এর হাতে যে ‘গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে’ বা ত্রিকোণমিতিক জরিপের সূচনা হল মাদ্রাজে, অর্ধশতক ধরে সারা ভারত জুড়ে চলা সেই সমীক্ষা সমসময়ের বিশ্বে তুলনারহিত।
এই সমীক্ষার কেন্দ্রে ছিল ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্ক অব দ্য মেরিডিয়ান’ বা সংক্ষেপে ‘গ্রেট আর্ক’, অর্থাৎ ভারতের উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত দ্রাঘিমারেখা, যার সাপেক্ষে সব মাপজোখ করা হবে। এর ফলে শুধু যে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নিখুঁত মানচিত্র তৈরি হল তা-ই নয়, পৃথিবীর আকার-আয়তন সম্পর্কেও নতুন তথ্য পাওয়া গেল, আর চিহ্নিত হল বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ!
মনে রাখতে হবে, এই সবই ঘটল সেই সময় যখন কম্পিউটার স্বপ্নেরও অতীত। তা হলে এত জটিল মাপজোখ কী ভাবে হবে? জরিপের কাজে একটা যন্ত্র ছিল খুব দরকারি, ‘থিয়োডোলাইট’। এটা আসলে এক ধরনের উঁচু মানের টেলিস্কোপ, যা কিনা এমন ভাবে একটা যন্ত্রের উপর বসানো হয় যাতে তাকে উল্লম্ব ও অনুভূমিক দু’ভাবেই ঘোরানো যায়। সে সময় সারা পৃথিবীতে এমন যন্ত্র দু’-তিনটের বেশি ছিল না। ল্যামটন লন্ডনে এমন একটির সন্ধান পেলেন। সে আবার জাহাজে করে আনার পথেও নানা রকম বিপত্তি। যা হোক, তাই দিয়েই বহু দিন কাজ চলেছে।
ল্যামটনের পর জর্জ এভারেস্ট যখন সার্ভের দায়িত্ব নিলেন, তিনি লন্ডন থেকে একটা থিয়োডোলাইট তৈরি করে আনলেন (১৮৩০)। অনেক দুর্যোগ-দুর্ঘটনা কাটিয়ে সেও কাজ দিয়েছে প্রায় চার দশক। এভারেস্ট-এর পরবর্তী সার্ভেয়ার জেনারেল অ্যান্ড্রু ওয়া-র সময় তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী সৈয়দ মির মহসিন হুসেন নামে সার্ভের এক সুদক্ষ যন্ত্রবিদ আর একটি থিয়োডোলাইট তৈরি করেন, এই কলকাতায় বসে।
১৯১৬ সালে সার্ভে অব ইন্ডিয়া এই শেষ দু’টি থিয়োডোলাইট ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে দিয়ে দেন। এ বার ভিক্টোরিয়ার বর্তমান সেক্রেটারি-কিউরেটর সমরেন্দ্র কুমারের আগ্রহে সে দু’টি দর্শকদের সামনে এল। উপরে তাদেরই ছবি, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-এর সৌজন্যে।
নব রূপে
কবি ও গীতিকার অমিয় বাগচীর (ছবি) লেখা বেশির ভাগ গানে সুর দিয়ে গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তৈরি হয় ‘কথা কোয়ো নাকো শুধু শোনো’, ‘এসো কুঞ্জে গো মধুজোছনায়’-এর মতো গান। দুই বন্ধু একত্রে প্রকাশ করেন গানের বই, কলহংস। এ বার অমিয় বাগচীর দৌহিত্র অরিজিৎ মৈত্রের সম্পাদনায়, যোগেন চৌধুরীর ছবিতে নব রূপে প্রকাশ বইটির (প্রকা: ঋত), ২৮ অগস্ট সন্ধে সাড়ে ৬টায় ‘গ্যালারি চারুবাসনা’য়, অমিয়ের পঞ্চাশতম প্রয়াণদিনে। কলহংস-র মূল অংশের সঙ্গে থাকছে অমিয়কে লেখা রবীন্দ্রনাথ ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘অপ্রকাশিত’ পত্র; তাঁকে নিয়ে বিকাশ রায় দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের লেখা। অমিয়ের লেখা গান গেয়েছিলেন শচীন গুপ্ত তালাত মাহমুদ তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় সমরেশ রায় বেলা মুখোপাধ্যায় সন্তোষ সেনগুপ্ত, কিছু গানে সুর দেন সুধীরলাল চক্রবর্তী, কমল দাশগুপ্ত; সেই সব তথ্য, ছবিও।
পূর্ণতার পথে
হেনস্থা ধেয়ে আসে নানা ভাবে, নানা দিক থেকে। কখনও শারীরিক, মানসিক কখনও। জায়গাটা হতে পারে খেলার মাঠ বা ক্লাসরুম, অন্য জনপরিসর। এ শহরের কোথাও কি নিজেদের পুরোপুরি ‘নিরাপদ’ বলে ভাবতে পারেন অটিস্টিক মানুষেরা, বা অন্য প্রতিবন্ধযুক্ত নাগরিকেরা? ললিত গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে সম্প্রতি কিস্টোন ইনস্টিটিউট ইন্ডিয়া-র উদ্যোগে দু’দিন ব্যাপী এক কর্মশালা হয়ে গেল, ‘সোশ্যাল রোল ভ্যালরাইজ়েশন’-এর মাধ্যমে এই মানুষদের জীবন পূর্ণ, মূল্যবান করে তোলার লক্ষ্যে। প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিবন্ধযুক্ত মানুষদের জন্য এমন আবাসিক পরিষেবা হোক যেখানে তাঁরা সসম্মানে জীবন কাটাতে পারেন, কথা হল তা নিয়েও। কথা বললেন সংস্থা-অধিকর্তা এলিজ়াবেথ নিউভিল, তিন দশকেরও বেশি সময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবন্ধসঙ্কুল জীবনে স্বপ্ন জোগাচ্ছেন যিনি।
জেলের চিঠি
“এত গরমে ফ্যানের কথাটা মনে পড়ে বই কি! তবে এখানে একটা করিয়া হাতপাখা পাওয়া গিয়াছে, তাই রক্ষা! পাখা মা দিয়া গিয়াছিলেন।” ১৯৩১-এর ১ মে, আলিপুর জেল থেকে লিখছেন বিপ্লবী দীনেশচন্দ্র গুপ্ত। সে বছর ৭ জুলাই আলিপুর জেলে ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয় তাঁর। বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে কারাবাস হয়ে উঠেছিল ‘কারাবরণ’, জেল থেকে লেখা অজস্র চিঠি তাঁদের শৌর্য ও দার্ঢ্যের সাক্ষ্যবহ। অরবিন্দ ঘোষ, দীনেশ গুপ্ত ও সুভাষচন্দ্র বসুকে এক সূত্রে গেঁথে সে কথাই বলবেন অধ্যাপক সুগত বসু, ‘জেলের অভিজ্ঞতা, জেলের চিঠি’ শিরোনামে, আগামী ৩১ অগস্ট সন্ধ্যা ৬টায় আলিপুর মিউজ়িয়মে— একদা কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার, এখন বাংলার মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মৃতি-সংগ্রহালয় যেটি।
কবিতা-উৎসব
এ যেন কবিতার বর্ষণ। অ্যান্টোনিম কমিউনিটি অব গ্লোবাল আর্ট অ্যান্ড লিটারেচার-এর আয়োজনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রিগুণা সেন প্রেক্ষাগৃহে গত ২০ অগস্ট হয়ে গেল আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব, ‘কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স’। কবিতা পাঠ, কাব্য নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি ছিল কাব্যাভিনয়, উত্তর-পূর্বের কবিতার সঙ্গতে ওড়িশি নৃত্য, কবিতার চলচ্চিত্র; প্রকাশ পেল কবিতার অনুবাদগ্রন্থও। উৎসবের আগে পূর্ণেন্দু পত্রী শিল্পগ্রামে আয়োজিত কর্মশালায় অনূদিত কবিতার পাঠও ছিল উৎসবে। ছিলেন ভারতের ওড়িশা, অসম, অরুণাচল প্রদেশের কবিরা যেমন, আবার ফ্রান্স, বেলজিয়ামের কবিরাও। বাংলার প্রতিনিধিত্বে মৃদুল দাশগুপ্ত চৈতালী চট্টোপাধ্যায় যশোধরা রায়চৌধুরী প্রমুখ, আসরশেষে কবিতাবীক্ষায় জয় গোস্বামী।
নতুন নাটক
নানা চরিত্র একে একে পেরিয়ে এসেছেন নট-নির্দেশক গৌতম হালদার, একটি পূর্ণাঙ্গ মহাকাব্য মঞ্চায়ন করেছেন একক অভিনয়ে। এ বার ফিয়োদর দস্তয়েভস্কির দোরগোড়ায় তিনি, আগামী ১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার অ্যাকাডেমি মঞ্চে সন্ধে সাড়ে ৬টায়, ‘নয়ে নাটুয়া’র নতুন নাটক মিতালী নিয়ে। চারটি রাতের গল্প। তারায় ভরা আকাশের নীচে কিশোরমনের রাত, যে বয়সে মনে হয় এমন ঝলমলে আকাশের নীচে নষ্ট মন আর বদমেজাজ নিয়ে কী করে বাঁচে মানুষ। এই কিশোর প্রেমের গল্পে মোবাইল ছিল না, খবর দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যম ছিল চিঠি লেখা। সব কিশোর-কিশোরীরই থাকে প্রেমের চিঠির ইতিহাস, তারই সূত্রে মিলেমিশে যায় অতীত-বর্তমান। অভিনয়ে গৌতম নিজে, সঙ্গে দ্যুতি ঘোষ হালদার আর অন্য কুশীলব ও নাট্যকর্মীরা।
শহরে ব্রেখট
১২৫ বছর পূর্ণ হল বের্টোল্ট ব্রেখট-এর। বাংলা থিয়েটারে এই প্রবাদপ্রতিম নাট্যকার, মঞ্চব্যক্তিত্ব ও কবির সৃষ্টি ও ভাবনার উদ্যাপন হয়েছে নানা সময়ে নানা ভাবে— তিন পয়সার পালা, গ্যালিলিওর জীবন (ছবি) সহ কলকাতার সংস্কৃতি-ইতিহাসে থেকে যাওয়া নানা প্রযোজনা তার সাক্ষী। এ বার কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি (কেসিসি) নিয়ে আসছে ব্রেখটকে ঘিরে ছ’দিন ব্যাপী কর্মকাণ্ড— ‘ব্রেকিং দ্য ফোর্থ ওয়াল: রিডিসকভারিং ব্রেখট’ নামে, অভিলাষ পিল্লাইয়ের কিউরেশনে। আজ থেকে ৩১ অগস্ট পর্যন্ত কেসিসি-তে এক গুচ্ছ অনুষ্ঠান: বক্তৃতা, আলোচনা, নাট্য-কর্মশালা, ব্রেখট-এর নাটকের মঞ্চায়ন, চলচ্চিত্র প্রদর্শন— এই সময়ের উদীয়মান ও লব্ধপ্রতিষ্ঠ সংস্কৃতি-ব্যক্তিত্বদের হাত ধরে। থাকছে আর্ট ইনস্টলেশন, আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘ব্রেখট ইন ইন্ডিয়া’ ও ‘ব্রেখট ইন বেঙ্গল’। বিশদ তথ্য ও সূচি জানা যাবে কেসিসি-র ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে।
স্মরণীয়
ছৌ-শিল্পের প্রসিদ্ধ ঘরানা সেরাইকেলা ছৌ, সেরাইকেলার মহারাজা ও রাজপরিবারের পোষণায় তার প্রচার-প্রসার। প্রথমে শুধুই রাজপরিবারে ও পুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, সেই প্রথা ভেঙে মঞ্চে আসেন কুমারী বাণী, বাণী মজুমদার। একলা মেয়ের দেশে-বিদেশে পুরুষদের সঙ্গে ঘুরে নৃত্য পরিবেশন সম্ভব হয়েছিল মা রেণুকাময়ীর প্রেরণায়। মায়ের কথায়, হরেন ঘোষের সহায়তায় বাণী ভর্তি হন কলাভবনে, আসেন রবীন্দ্র-সান্নিধ্যে। সব ভাইবোনই শিল্পের অঙ্গনে স্মরণীয় বরণীয়: লিখন-চিত্রণে কমলকুমার, চিত্রশিল্পে নীরদ মজুমদার ও শানু লাহিড়ী, রাগসঙ্গীতে দক্ষ শিল্পী গীতা, সেরাইকেলা ছৌ নাচে বাণী (ছবি)। এ বার তাঁর কন্যা তিলোত্তমা দাসের লেখায় প্রকাশ পেল বই ছন্দবন্ধনে কুমারী বাণী (প্রকাশক: কারিগর), গত ১৮ অগস্ট রোটারি সদনে।
জরুরি কথা
‘জাস্ট রিপাবলিক’: বাংলায় হয়তো উপযুক্ত অনুবাদ ‘ন্যায়সম্মত সাধারণতন্ত্র’। ন্যায্য-র বদলে ন্যায়সম্মতই বেশি প্রযোজ্য, প্রসঙ্গের ভার তাতে যথার্থ ধরা পড়ে। ইতিহাস-তাত্ত্বিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আগামী বই জাস্ট রিপাবলিক-এর সংবাদ এ ভাবনা উস্কে দেয়। শব্দের ব্যঞ্জনা বিষয়ক ভাবনা চলে আসে এ কারণেও, যে-হেতু বইয়ের অন্যতম মুখ্য উপজীব্য: ভারতে কী ভাবে ‘নেশন’ ও ‘স্টেট’ দু’টি শব্দ ও ধারণা পরস্পরের ব্যঞ্জনা-দূরত্ব ঘুচিয়ে প্রায়-প্রতিশব্দ রূপে ব্যবহারের চল হয়েছে। অথচ স্বাধীনতার পর নতুন সংবিধান রচনার সময় শক্তপোক্ত ‘রাষ্ট্র’ব্যবস্থা তৈরির সঙ্গে সঙ্গে ‘জাতি’ হিসেবে দেশের অন্তর্লীন বহুত্বকে মর্যাদা দিয়ে চলার চেষ্টা হয়েছিল। আজকের রাজনীতি ও সমাজ সেই ভারসাম্য নষ্ট করছে বিপজ্জনক ভাবে। জরুরি এই বইটির প্রথম অধ্যায় ঘিরে গত ২৩ ও ২৫ অগস্ট বললেন তিনি, সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ।