প্রতীকী ছবি।
কথা উঠলেই সুমিত্রা বলতেন, ‘‘লোকসভা ভোটে আমাদের অত কী? বিধানসভার সময় ভাবব।’’ স্ত্রীয়ের কথায় সহমত হতে না পারা বিজয়বাবু পাল্টা বলতে শুরু করতেন, ‘‘কোনওটাই ফেলার নয়। সব ভোটই গুরুত্বপূর্ণ।’’ এক দু’কথায় লেগে যেত দু’জনের।
মাঝের সময়টায় স্বামী-স্ত্রীয়ের মধ্যে তৈরি হয়েছে ব্যবধান। দাম্পত্যের সম্পর্ক পৌঁছেছে আদালতে। তবুও পুরনো ভাল দিনের স্মৃতি মনে পড়লে এখনও হেসে ফেলেন সত্তরোর্ধ্ব। তার সঙ্গেই হয়তো স্মৃতিতে ফিরে আসে নোট বাতিলের জেরে স্ত্রীকে খোরপোশের টাকা দিতে না পারায় হাজতবাসের সেই অভিজ্ঞতাও। ভোট নিয়ে কথা বলতে বলতেই তাই চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বৃদ্ধের। বলেন, ‘‘মতবিরোধ করার মতো আর লোক নেই। গত কয়েক বছরে যে অপমান পেয়েছি, তা ভুলব কী করে? নোট বাতিলের জন্য আমায় জেলে থাকতে হয়েছে। জেলের দিনগুলোই তো চোখের সামনে ভাসে!’’
২০১৬ সালের ৯ নভেম্বর। নগর দায়েরা আদালতের নির্দেশে স্ত্রীয়ের খোরপোশের ২ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা মেটানোর কথা ছিল কলেজ স্ট্রিটের রাধানাথ মল্লিক লেনের বাসিন্দা বিজয় শীলের। টাকার ব্যবস্থা করেও ফেলেছিলেন তিনি। কিন্তু, তার আগের দিন, অর্থাৎ ৮ নভেম্বর রাতে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেন, ওই দিন রাত ১২টার পর থেকে ৫০০ এবং এক হাজার টাকার নোট বাতিল। কয়েক নিমেষে সব টাকা তখন শুধুই কাগজের টুকরো। এক রাতের মধ্যে বাতিল নোটের পরিবর্তে ওই পরিমাণ নতুন নোটের আর ব্যবস্থা করতে পারেননি বিজয়বাবু।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
আদালতের নির্দেশে নির্দিষ্ট দিনে টাকা না মেটানোয় বিজয়বাবুকে জেলে যেতে হয়। টানা ১৭ দিন জেলে থাকার পরে হাইকোর্ট থেকে জামিন পান বিজয়বাবু। পরিবারের সকলের সাহায্যে পরে নতুন নোটে স্ত্রীয়ের খোরপোশের টাকা মেটান বিজয়বাবু। তাঁর মনে পড়ে, খোরপোশ মেটাতে না পারার দিন যখন বিজয়বাবু জানিয়েছিলেন, এক রাতের মধ্যে এত নতুন টাকা জোগাড় করতে পারেননি, চুপ করে শুনেছিলেন স্ত্রী। ১৯৭৮ সালে বিয়ে হয়েছিল যাঁর সঙ্গে, টাকা মেটানোর জন্য বাড়তি ক’টা দিন সময়ও পাননি সেই স্ত্রীর থেকে। বিজয়বাবুর দাবি, টাকা মেটানোর দিন নোটগুলি সব নতুন কি না তাও দেখে নিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী। এর পরেও বিবাহবিচ্ছেদের মামলা চালিয়ে গিয়েছেন বিজয়বাবু। নিজেই আদালতে সওয়াল করেছেন। এখন রাজ্য সরকারের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীয়ের একটি মামলা চলছে। এ নিয়ে অবশ্য আর মন্তব্য করতে চাননি সুমিত্রাদেবী। ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘সেই সময় আদালত যা রায় দিয়েছিল তা-ই মেনে নিয়েছি।’’
পরিবারের সঙ্গে এখন দিল্লি বেড়াতে গিয়েছেন বিজয়বাবু। সেখান থেকেই জানান, আগামী রায় যাই হোক, বিচার ব্যবস্থার উপরে সম্পূর্ণ আস্থা রয়েছে তাঁর। সেই সঙ্গে বলেন, ‘‘নোট বাতিলের জেরে কার কী উপকার হয়েছে বলতে পারব না। আমি শুধুই অপমানিত হয়েছি। আমি জেল খাটার মতো অন্যায় করিনি।’’
ভোটের মুখে বিজয়বাবুর ঘটনা নিয়ে নতুন করে চর্চা শুরু হয়েছে মধ্য কলকাতার রাজনীতিতে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র বলছেন, ‘‘রাতারাতি নোট বাতিলের জেরে অনেকে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। বিজয়বাবুর মতো মানুষেরা ভোটে তার জবাব দেবেন। এটাই পৃথিবীর প্রথম রাষ্ট্র, যেখানে মানুষের নিজের টাকা নিজে ব্যবহারের অধিকার ছিল না।’’
রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ অবশ্য বলছেন, ‘‘যে কোনও ভাল কাজ করতে গেলে কিছু মানুষের সমস্যা হয়। ওই ব্যক্তির তা-ই হয়েছে। এটাকে ভোটে হাতিয়ার করে লাভ হবে না।’’ সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর মন্তব্য, ‘‘নেতা-মন্ত্রীরা লম্বা-চওড়া ভাষণ বন্ধ করে বরং এই মানুষগুলোর মনের কথা বোঝার চেষ্টা করুন।’’