মরণোত্তর অঙ্গদানে এখনও তৈরি নয় হাসপাতাল

জীবদ্দশায় তিনি চাইতেন, বিপদে-আপদে মানুষের পাশে দাঁড়াতে। মৃত্যুর পরে পরিবারের লোকেরা তাঁর সেই মানসিকতাকেই সম্মান জানাতে এগিয়ে এসেছিলেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৬ ০২:৫০
Share:

শোভনা সরকার

জীবদ্দশায় তিনি চাইতেন, বিপদে-আপদে মানুষের পাশে দাঁড়াতে। মৃত্যুর পরে পরিবারের লোকেরা তাঁর সেই মানসিকতাকেই সম্মান জানাতে এগিয়ে এসেছিলেন। হাসপাতাল ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষণার পরে তাঁর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ কী ভাবে অন্য একাধিক মুমূর্ষু মানুষকে দান করে তাঁদের নতুন জীবনে ফেরানো যায়, সে জন্য সোমবার দিনভর ছুটে বেড়ালেন তাঁরা। কিন্তু শুধুমাত্র পরিকাঠামোর অভাবে রাজ্যের সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল এসএসকেএম নিতেই পারল না ৭০ বছরের শোভনা সরকারের লিভার।

Advertisement

মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরে অঙ্গদানের বিষয়টি যে এ রাজ্যে এখনও সংগঠিত আকার নেয়নি সোমবারের ঘটনা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। বস্তুত এই সংক্রান্ত কোনও পরিকাঠামোই এখনও সরকারি হাসপাতালে তৈরি হয়নি। এসএসকেএম কর্তৃপক্ষের সাফাই, যেহেতু রাজ্যে বিষয়টি নিয়ে সরকারি তরফেও এখনও কোনও উদ্যোগ নেই, তাই তাদের তরফেও তৎপরতা গড়ে ওঠেনি। খোদ স্বাস্থ্যকর্তারাই মেনে নিয়েছেন, রাজ্যের কোনও হাসপাতালে কোনও রোগীর মস্তিষ্কের মৃত্যু হলে তা দ্রুত ঘোষণার জন্য নির্দিষ্ট কমিটি নেই। মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরে অঙ্গ প্রতিস্থাপনে বাড়ির লোককে রাজি করানোর জন্য কাউন্সেলর নেই। এমন কোনও তথ্যপঞ্জিও নেই যা থেকে বোঝা যাবে কোন হাসপাতালে ভর্তি কোন রোগীর কোন অঙ্গটি ওই মুহূর্তে প্রয়োজন। ফলে লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য হাপিত্যেশ করে অপেক্ষা করেন অনেকে। কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য পড়তে হয় প্রতারকদের পাল্লায়। চোখের জন্য চলে অনন্ত প্রতীক্ষা।

কেন মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘোষণার ক্ষেত্রে এখনও পিছিয়ে রয়েছে এ রাজ্য? স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, এ বিষয়ে একটি ফাইল দীর্ঘদিন যাবৎ মুখ্যমন্ত্রীর টেবিলেই পড়ে ছিল। এ ছাড়াও বিভিন্ন দফতরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবও এর বড় কারণ।

Advertisement

স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, ‘‘কিছু কিছু কারণে আটকে ছিল। শীঘ্রই এই সংক্রান্ত কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা করব।’’ প্রশ্ন উঠেছে, এর আগেও তো এই ভাবে নানা বাধা বিপত্তি পেরিয়ে এক-আধ জনের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরে অঙ্গদানের ব্যবস্থা করা গিয়েছিল। তখনও স্বাস্থ্যকর্তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আর কোনও বাধা থাকবে না। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা হয়নি। এ বারেও যে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, তার কি নিশ্চয়তা? এই প্রশ্নের কোনও স্পষ্ট উত্তর অবশ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তার কাছে পাওয়া যায়নি।

শোভনাদেবীর ক্ষেত্রেও পরিণতিটা একেবারেই নেতিবাচক হতে পারত। তবে লিভার দেওয়া সম্ভব না হলেও কিডনি বা চোখের মতো অঙ্গ যে দেওয়া গিয়েছে, তা পুরোটাই তাঁর পরিবারের মনের জোরের কারণে। তাঁর ছেলে প্রসেনজিৎ সরকার বলেন, ‘‘স্বাস্থ্য অধিকর্তার সাহায্য পেয়েছি। মুখ্যমন্ত্রীর দফতরেও যোগাযোগ করেছিলাম আমি। আসলে যে করেই হোক কাজটা করব সে ব্যাপারে বদ্ধপরিকর ছিলাম। যদি এ রাজ্যে না হত, তা হলে মা’কে ভেন্টিলেটর সাপোর্ট দিয়ে চেন্নাই নিয়ে যেতাম। ওখানে প্রক্রিয়া অনেক সহজ।’’ কোনও বিশেষ পরিচিতিহীন কোনও সাধারণ পরিবারের পক্ষে প্রিয়জনের মৃত্যুর সময়ে যা করা খুবই কঠিন।

স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে গত ২০ জুন গড়িয়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন শোভনাদেবী। পরে তাঁর আরও একাধিক শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। ২৩ জুন হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর মস্তিষ্কের মৃত্যু হয়েছে। তা জেনেই পরিবারের লোকেরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা শোভনাদেবীর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ দান করবেন। ওই হাসপাতালের আইটিইউ-এর ইনচার্জ, চিকিৎসক অজয় সরকার জানান, প্রোটোকল মেনে তাঁরা রোগিণীর আরও পরীক্ষানিরীক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। ২৫ তারিখ সরকারি ভাবে মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘোষণা হয়। পরিবারের লোকেরা স্বাস্থ্য দফতরে যোগাযোগ করেন। সোমবার স্বাস্থ্য দফতরের মনোনীত কমিটির সদস্যরা এসে শোভনাদেবীকে পরীক্ষা করে ওই সিদ্ধান্তে সিলমোহর দেন।

তবে গড়িয়ার ওই হাসপাতালে মৃতদেহ থেকে অঙ্গ সংগ্রহের ব্যবস্থা না থাকায় শোভনাদেবীর পরিবারের তরফেই যোগাযোগ করা হয় বিভিন্ন হাসপাতালে। রাজ্যে সরকারি পরিকাঠামোয় একমাত্র এসএসকেএম-এই যেহেতু এর আগে লিভার প্রতিস্থাপন হয়েছে, তাই যোগাযোগ করা হয় সেখানে। কিন্তু শোভনাদেবীর লিভার কাজে লাগাতে পারেনি এসএসকেএম হাসপাতাল। তারা এ দিন জানিয়ে দেয়, এই মুহূর্তে তড়িঘড়ি কোনও গ্রহীতার ব্যবস্থা করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

প্রসেনজিৎবাবু বলেন, ‘‘ব্রেন ডেথের কথা জানার পরেই পরিবারের সকলে, এমন কী আমার বাবাও মিলিত ভাবে সিদ্ধান্ত নিই যে মায়ের অঙ্গগুলি যাতে অন্যের কাজে লাগে তার ব্যবস্থা করব।’’

সোমবার বিকেলেই তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছিল মিন্টো পার্কের এক বেসরকারি হাসপাতালে, যেখানে মৃতদেহের অঙ্গ সংরক্ষণের ব্যবস্থা চলছে। রাতেই তাঁর একটি কিডনি ৩০ বছরের এক তরুণীর শরীরে প্রতিস্থাপিত হয়। অপর কিডনিটি যায় এসএসকেএম-এ অপর এক গ্রহীতার কাছে। চোখ সংগ্রহ করে নিয়ে যায় আর একটি বেসরকারি হাসপাতাল।

পরিকাঠামো তৈরির ব্যাপারে সরকারি তরফে নিষ্পৃহতা থাকলেও অঙ্গদানের প্রায় বিরল এই মানসিকতাকে স্বাগত জানিয়েছেন রাজ্যের চিকিৎসক মহল। গ্যাসট্রোএন্টেরোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরী বলেন, ‘‘মস্তিষ্কের মৃত্যুই যে আসল মৃত্যু, তা বোঝা জরুরি। অঙ্গ নিয়ে ব্যবসা, কিডনি পাচার— সবই ঠেকানো সম্ভব সদিচ্ছার মাধ্যমে।’’

মৃত্যুর পরে অঙ্গ দান নিয়ে দীর্ঘ দিন আন্দোলন করছেন যিনি, সেই ব্রজ রায় বলেন, ‘‘তামিলনাড়ু অনেক আগেই যা পেরেছে, আমরা কিছুতেই পেরে উঠছি না, এটাই লজ্জার।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement