সোমবার রং খেলার পরে স্নানের ভিড় হাওড়ার রামকৃষ্ণপুর ঘাটে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
‘উৎসবের রঙিন আনন্দ যেন বড় বিপদ ডেকে না আনে’— বসন্তোৎসবকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণির মানুষের মাতামাতি দেখে এমনই আক্ষেপ শহরের এক চিকিৎসকের। বললেন, ‘‘এক বছর আগের দিনটা বোধহয় অনেকেই ভুলে গিয়েছেন। তাই ফের মাস্ক খুলে, দূরত্ব-বিধি শিকেয় তুলে রং খেললেন।’’
বঙ্গে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়া নিয়ে চিকিৎসকদের একাংশ বার বার যে বিষয়টিকে দায়ী করছেন, তা হল ‘ঢিলেঢালা মনোভাব’। আর তার সঙ্গেই অবাধ উৎসব পালন কতটা বিপদ ডেকে আনতে পারে, রবিবার দোলের পরে তারই প্রমাদ গুনছেন চিকিৎসক থেকে সংক্রমণ বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের কথায়, ‘‘শহরে সম্প্রতি পর পর দু’টি ব্রিগেড ও রাজনৈতিক সভা-মিছিলের ফল এখন মিলছে। দোলের ফলাফল পেতে অপেক্ষা করতে হবে আরও অন্তত ১০-১২ দিন।’’
অতিমারির চরিত্র অনুযায়ী যে কোনও সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ যে আগের বারের তুলনায় বেশি প্রভাব ফেলতে পারে, সে বিষয়ে সতর্ক করে দিচ্ছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অনির্বাণ দলুই। তিনি বলছেন, ‘‘অন্যান্য দেশের অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা গিয়েছে, দ্বিতীয় ঢেউয়ে কম বয়সিরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। তার উপরে এই মুহূর্তে দোল-হোলি, ভোট, নববর্ষ ইত্যাদি সব কিছু নিয়ে খুব কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা। তাই কোভিড-বিধি মেনে চলতেই হবে।’’
পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের ২৮ মার্চ এ রাজ্যে ৭৬ ও ৫৬ বছর বয়সি দুই মহিলার দেহে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। ঠিক এক বছর পরে ওই একই তারিখে রাজ্যে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা ৮২৭। তার মধ্যে কলকাতায় ২৯২, উত্তর ২৪ পরগনায় ১৯৩, হাওড়ায় ৬৮ এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ৩৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘গত বছর রাজ্যে জুলাইয়ের প্রথম দিকে দৈনিক আক্রান্ত আটশোর ঘরে পৌঁছেছিল। এ বছর সেটা পাঁচ মাস আগে মার্চেই হয়ে গেল। বোঝাই যাচ্ছে, বিপদ কতটা বাড়ছে।’’
কিছু মানুষের বেপরোয়া মনোভাবই করোনাভাইরাসকে আরও ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করছে বলে মনে করছেন কার্ডিয়োথোরাসিক সার্জন কুণাল সরকার। তিনি জানাচ্ছেন, এক দিকে অবাধ রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে দোল উৎসবের বাঁধনছাড়া আনন্দ যেমন দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে, তেমনই রাজ্যে দৈনিক করোনা পরীক্ষাও তুলনায় কম হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘অ্যান্টি ভাইরাল ওষুধ তৈরি এবং ৩০-৪০ শতাংশ মানুষকে প্রতিষেধক দেওয়া— মানুষের হাতে প্রতিরোধ ক্ষমতা বলতে কিন্তু এই দু’টিই। অথচ এখনও ওষুধ তৈরি হয়নি। দেশে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৪ শতাংশ এখনও পর্যন্ত প্রতিষেধক পেয়েছেন। তাই এই পরিস্থিতিতে ঢিলেঢালা মনোভাব আমাদের ত্যাগ করতে হবে।’’
ফের করোনার যে প্রকোপ শুরু হয়েছে তাতে কিছু ক্ষেত্রে নতুন স্ট্রেন রয়েছে বলে জানাচ্ছেন ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজি’-র ইমিউনোলজিস্ট দীপ্যমান গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘নতুন স্ট্রেনের ক্ষেত্রে স্পাইক প্রোটিনে পরিবর্তন রয়েছে। ইতিমধ্যে কলকাতায় দক্ষিণ আফ্রিকার স্ট্রেন মিলেছে। সেটা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর ওই স্ট্রেনের ক্ষেত্রে কোভিশিল্ড প্রতিষেধক কাজ করবে না। অন্যান্য প্রতিষেধক কাজ করবে কি না, তা-ও অবশ্য এখনও জানা যায়নি।’’ দীপ্যমান আরও জানাচ্ছেন, প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলা মানেই কিছু মানুষের জীবন নিয়ে আশঙ্কা বেড়ে যাওয়া।
কিন্তু এ নিয়ে আমজনতা আদৌ চিন্তিত কি, সেই প্রশ্নটাই ভাবাচ্ছে চিকিৎসকদের।