এই সেই আফগান মিনার। নিজস্ব চিত্র
ইতিহাসের সরণি বেয়ে যাত্রায় এমন রোমাঞ্চিত হওয়ার সুযোগের কথা ক’জন জানেন! রোজনামচার শহরের গর্ভগৃহে অন্য এক শহরের গল্প লুকোনো রয়েছে দমদম অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে।
এইচএমভি, জেসপ কারখানা, কলকাতা বিমানবন্দরের প্রতিবেশী এই কারখানার অন্দরেই সযত্নে রাখা রয়েছে এক ‘বায়োস্কোপ’, যেখানে চোখ রাখলে মুহূর্তে পৌঁছে যাওয়া যাবে আফগানিস্তানের যুদ্ধক্ষেত্রে! আবার পলক প়ড়তেই ভেসে উঠবে সিপাহি বিদ্রোহের অজানা তথ্য। দমদম ক্যান্টনমেন্টের ১৯০৮-০৯ সালের মানচিত্র চোখের সামনে মেলে ধরলে চড়ে বসা যাবে টাইম মেশিনে। লুকোনো সেই ইতিহাসকে এ বার চার দেওয়ালের বাইরে আনার পরিকল্পনা করছেন দমদম অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি কর্তৃপক্ষ। ফ্যাক্টরির প্রশাসনিক আধিকারিক জানান, কলিকাতা দর্পণ, কমল চৌধুরীর ‘উত্তর ২৪ পরগনার ইতিবৃত্ত’, স্টেট আর্কাইভের ম্যাপ দেখলেই স্পষ্ট হয়, এই কারখানা এবং দমদমের ইতিহাস কতটা তাৎপর্যপূর্ণ!
বাংলার নবাবি শাসনকে দমিয়ে ইংরেজ আধিপত্য সূচনা করার মতোই এই কাহিনিরও স্রষ্টা লর্ড ক্লাইভ। দক্ষিণ দমদম পুর এলাকার নাগেরবাজারের রাষ্ট্রগুরু অ্যাভিনিউ। সেখানেই রয়েছে উঁচু ঢিবি বা ‘দমদমা’। যার উপরে ছিল লর্ড ক্লাইভের বাগানবাড়ি। ১৭৫৭-৬০ এবং ১৭৬৫-৬৭― দু’দফায় সেখানে থাকতেন ক্লাইভ। অস্ত্র মেরামতির জন্য তাঁর বাসস্থানের কাছাকাছি ক্লাইভ একটি ওয়ার্কশপ গড়ে তোলেন। সেই শুরু।
ক্রমে গোলন্দাজ বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে সেই ওয়ার্কশপ বেঙ্গল আর্টিলারির সদর দফতরে পরিণত হয়। যা ১৮৫৩ সালে মেরঠে স্থানান্তরিত হয়। যদিও দমদম ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক অবধি সচল ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে কাশীপুর গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরির অধীনে কয়েক বছর ছিল এই কারখানা। ১৯৬৪ সালে ভারত-চিন যুদ্ধের পরে ফের স্বাধীন অস্তিত্ব ফিরে পায় দমদম অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীন আরও ৪০টি অস্ত্র কারখানার সঙ্গে এটিও বর্তমানে অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা সামগ্রী তৈরি করে চলেছে।
কারখানা চত্বরে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে ইতিহাস বলে চলেছে ‘আফগান মিনার’। অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির প্রশাসনিক আধিকারিক বাপ্পাদিত্য দত্ত জানান, ১৮৪১-৪২ সালে প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় হয়েছিল ব্রিটিশদের। নিহত ব্রিটিশ সৈন্যদের স্মৃতির উদ্দেশে ১৮৪৩-৪৪ সালে বেঙ্গল হর্স আর্টিলারির সহযোদ্ধারা ‘আফগান মিনার’ নামে স্মৃতিস্তম্ভটি তৈরি করেন। ওই চত্বরেই রাখা রয়েছে পুরনো কামান। দু’টি ফলকে খোদাই করা আছে যুদ্ধে নিহত ব্রিটিশ অফিসারদের নাম। সেই ফলকেই লেখা রয়েছে মিনারের তথ্য।
গবেষক মৌমিতা সাহার কথায়, ‘‘দমদমে আফগান মিনার ছাড়াও রয়েছে ১৭৯০ সালে আর্টিলারি রেজিমেন্টের কর্নেল টমাস ডিন পিয়ার্সের স্মৃতির উদ্দেশে তৈরি ‘করিন্থিয়ান পিলার’।’’ যশোর রোড সংলগ্ন সেন্ট স্টিফেন্স স্কুল চত্বরে লোকচক্ষুর আড়ালে রয়েছে সেই মিনার। বাপ্পাদিত্যের কথায়, ‘‘আফগান যুদ্ধের হারের ময়না-তদন্তে নেমে ব্রিটিশরা দেখেন, ইংল্যান্ড থেকে আফ্রিকা ঘুরে এ দেশে যখন বারুদ পৌঁছচ্ছে তখন তা স্যাঁতসেঁতে হয়ে যাচ্ছে। তার ফলেই এই হার। সে কারণেই ১৮৪৬ সালে ভারতে প্রথম অ্যামিউনিশন ফ্যাক্টরি হিসাবে এই কারখানাটি গড়ে ওঠে।’’
দমদম অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে রয়েছে সিপাহি বিদ্রোহের স্মৃতিচিহ্নও। বাপ্পাদিত্য জানান, ১৮৫৩ সালে এনফিল্ড রাইফেলে ব্যবহৃত কাগজের টোটা বেরোতো এই কারখানা থেকেই। আর্দ্রতা ঠেকাতে টোটার খোলের উপরে চর্বি দিয়ে পালিশ করা হত। দেশীয় সেপাইদের এই টোটা দাঁতে কেটে খোলের
বারুদ গাদা বন্দুকের নলের উপরের মুখ দিয়ে ঢালতে হত। সেই টোটার উপাদান ঘিরেই তৈরি হয়েছিল যাবতীয় বিতর্ক! দমদম বুলেটকে ঘিরেই বা বিতর্ক কম কী! ১৮৯০-এর দশকে ‘দমদম বুলেট’-এর জন্যই এই অস্ত্র কারখানা আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিতি লাভ করে। রয়্যাল আর্টিলারির লেফটেন্যান্ট কর্নেল নেবিল বার্টি ক্লে বুলেটের ডগায় থাকা ধাতব আচ্ছাদনটি সরিয়ে দেন। যার ফলে বুলেট শরীর ফুঁড়ে বেরোনোর বদলে অনেকটা জায়গা জুড়ে ভয়ঙ্কর ক্ষত তৈরি করত। ১৮৯৯ সালে হেগ-এ অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে শিকার ছাড়া অন্যত্র এই গুলির ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়।
দমদম অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির জেনারেল ম্যানেজার সুধীর শ্রীবাস্তব বলেন, ‘‘এখনকার প্রজন্ম এই ইতিহাস নিয়ে অবহিত নয়। অজানা এই সব তথ্য সকলকেই যাতে গর্বিত করে সে ব্যাপারে আমরা সচেষ্ট। আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া, রাজ্য হেরিটেজ কমিশনকে আফগান মিনার পর্যবেক্ষণ করে তাদের মতামত জানানোর জন্য অনুরোধ করা
হয়েছে। তার পরেই মিনার সংরক্ষণে পরবর্তী পদক্ষেপ স্থির হবে। পাশাপাশি ফলকের সংস্করণ নিয়েও চিন্তাভাবনা হচ্ছে।’’