সাবেক: গত শতকের গোড়ায় এই রূপ পায় আজকের হাওড়া স্টেশন। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
কলকাতা বন্দরের বদলে জাহাজ পৌঁছে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায়। ট্রেনের বাষ্পচালিত ইঞ্জিন বা লোকোমোটিভ বয়ে আনা ‘কেডগ্রি’ নামের সেই জাহাজকে ১৮৫৪ সাল নাগাদ যখন কলকাতায় নিয়ে আসা হল, তখন দেরি হয়ে গিয়েছে অনেকটা। বিপত্তির তালিকায় ঢোকে জাহাজ ডুবির ঘটনাও। এইচএমএস গুডউইন নামের যে জাহাজে কোচ আসছিল, তা হুগলি নদীর মোহনায় স্যান্ডহেডের কাছে ডুবে যায়। জোড়া এই বিপদেই সম্ভবত দেশের মধ্যে এ শহর প্রথম রেলগাড়ি ছোটার সাক্ষী হতে পারল না।
কলকাতার যমজ শহর হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত রেলগাড়ি চালানোর প্রস্তুতিতে তার আগেই অবশ্য একাধিক প্রশাসনিক বাধা কাটিয়ে ওঠা গিয়েছিল। ঘরে-বাইরে নানা মতের সঙ্গে লড়াই তো ছিলই।
কোচ-সহ জাহাজ ডুবলেও জেগে রইল রেলগাড়ি ছোটার আশা। পরে ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের লোকোমোটিভ সুপারিন্টেনডেন্ট জে হজসনের তত্ত্বাবধানে দু’টি সংস্থা স্টুয়ার্ড অ্যান্ড কোম্পানি এবং সেটান অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় কোচ তৈরি হয়। প্রথম ট্রেনের রেকে তিনটি প্রথম শ্রেণির, দু’টি দ্বিতীয় শ্রেণির, তিনটি তৃতীয় শ্রেণির এবং একটি গার্ডের কামরা ছিল। যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হওয়ার পরে ১৮৫৪ সালের ২৮ জুন পরীক্ষামূলক ভাবে ট্রেন ছোটে। সেই বছরের ১৫ অগস্ট হুগলি পর্যন্ত রেলগাড়ি চালানো শুরু হয়।
দেশের অন্যতম বড় রেলওয়ে টার্মিনাস হাওড়ার নির্মাণ নিয়েও কম সমস্যা হয়নি। ট্রেন হাওড়া থেকে চলবে কি না, শুধু সেই সিদ্ধান্ত নিতেই কয়েক বছর কেটে যায়। এমনকি মূল স্টেশন হাওড়ায় নাকি আরও উত্তর দিকে হবে, তা স্থির করতে পাঁচ বছর পেরিয়ে যায়।
সলতে পাকানোর শুরু অবশ্য তারও এক দশক আগে। সে সময়ে এ দেশে রেলগাড়ি চালানোর তোড়জোড় শুরু করেন এক বাঙালি। রানিগঞ্জ এবং রাজমহল পাহাড় সংলগ্ন এলাকায় কয়লার খনি ছিল সেই বাঙালি ব্যবসায়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথের। কয়লা দ্রুত আনার উপায় খুঁজছিলেন তিনি। ১৮৪২ সালে ইংল্যান্ড গিয়ে প্রথম ট্রেনে চড়ার পরেই তাঁর মাথায় আসে দেশে রেলপথ তৈরির ভাবনা। পরের বছর জানুয়ারিতে দেশে ফিরে ইংরেজ সংস্থার সাহায্য নিয়ে রেলপথ তৈরির চেষ্টা শুরু করেন তিনি। প্রকল্পের এক তৃতীয়াংশ খরচ বহনেও রাজি ছিলেন।
কিন্তু বনিবনা না হওয়ায় গ্রেট ওয়েস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি তৈরি করে নিজেই কাজে নেমে পড়েন। ইংরেজ প্রভাবিত ইস্ট-ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানির দিক থেকে প্রবল বাধার মুখে পড়েন। কারণ ব্যবসায়িক এবং সামরিক স্বার্থে এ দেশীয়দের হাতে রেল চালনার ভার ছেড়ে দেওয়া নিয়ে আপত্তি ছিল ব্রিটিশদের। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিকারিকদের সঙ্গে আলোচনা করে অনুমতি আদায়ে ১৮৪৬ সালের অগস্টে ফের বিলেতে যান। কিন্তু সেখানেই তাঁর মৃত্যু হলে দ্বারকানাথের সংস্থা নিলামে উঠে ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানির সঙ্গে মিশে যায়।
পরে সেই সংস্থার ব্যবস্থাপনাতেই শুরু হয় রেলপথ নির্মাণ। শুরু থেকেই যার দায়িত্বে ছিলেন জর্জ টার্নবুল। ব্যবসায়িক এবং সামরিক গুরুত্ব বুঝে কলকাতার উপকণ্ঠে রেলপথ তৈরিতে টার্নবুলের অবদান অনস্বীকার্য। ভবিষ্যতের কথা ভেবে হাওড়া স্টেশন নির্মাণের জন্য যে বাড়তি জমি কেনা বা বেশি টাকা খরচের বিরুদ্ধে ছিলেন ব্রিটিশ আধিকারিকেরা। ফলে নদীর ধারে প্রশস্ত জমির ব্যবস্থা করতে হিমশিম খান টার্নবুল। ব্রিটিশদের সম্মতি আদায়ে প্রকল্প কাটছাঁট করতে হয় তাঁকে। শুরুতে আড়াই লক্ষ টাকা খরচ করে স্টেশন তৈরির প্রস্তাব আধিকারিকদের মনঃপূত হয়নি। বাধ্য হয়ে দু’লক্ষের কম টাকায় স্টেশন তৈরির পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হয়।
তবে টার্নবুলের তৈরি হাওড়া স্টেশনের গুরুত্ব বাড়তেই থাকে। যার ফলে ১৯০১ সালের পরে হ্যালসে রিকার্ডো নামে এক ইঞ্জিনিয়ারের পরিকল্পনায় তৈরি হয় আজকের হাওড়া স্টেশনের ১৪টি প্ল্যাটফর্ম। ১৯৮০ সালে তৈরি হয় নিউ কমপ্লেক্স। প্রতিদিন ছশোর বেশি ট্রেন ছাড়ে এখান থেকে। দৈনিক দশ লক্ষের বেশি যাত্রী যাতায়াত করেন। দেশের ১৩৭৩টি স্টেশনের সঙ্গে রেলপথে সরাসরি যোগ রয়েছে হাওড়ার।
অথচ এক সময়ে রেলপথ তৈরি নিয়ে দ্বন্দ্বের মতোই হাওড়ায় স্টেশন হবে কি না, সেই টানাপড়েনে কেটেছিল বহু বছর। টার্নবুলের দূরদর্শিতাই ডালপালা মেলে ছড়িয়েছে আজকের হাওড়া স্টেশনে।