অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
মধ্য কলকাতার উঠতি এক মস্তানকে ধরতে রওনা দিয়েছিল লালবাজারের গুন্ডাদমন শাখা। মাঝপথেই উপরমহলের ফোন আসে, ওই মস্তানকে এখনই ধরার দরকার নেই। বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন গোয়েন্দা অফিসারেরা।
পুজোর ঠিক পরেই মধ্য কলকাতার ওই মস্তান দলবল নিয়ে তিলজলায় হামলা চালায় কড়েয়ার এক প্রোমোটারের উপরে। গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় সেই প্রোমোটারের। মূল অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেফতার হয় মাস্টার নামে ওই দুষ্কৃতী। সোমবার, পুণে থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে মাস্টারের দাদা মিস্টারকেও। গোয়েন্দা অফিসারেরা হাত কামড়ে বলছেন, সে দিন উপরতলা গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়ে দিলে ওই ঘটনা ঘটত না।
এলাকার দুই প্রভাবশালী দুষ্কৃতীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার তোড়জোড় করছিলেন হরিদেবপুর থানার এক সাব-ইনস্পেক্টর। তাঁর আশঙ্কা ছিল, ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে কোনও দিন তারা বড় অপরাধ ঘটাবে। ওই অফিসার অবশ্য ব্যবস্থা নিয়ে উঠতে পারেননি। কারণ, সেই তোড়জোড় শুরু করতেই আচমকা তাঁকে ওই থানা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল লালবাজার।
সেই ঘটনার সাত মাস পরেই কবরডাঙার একটি পানশালায় ওই দুই দুষ্কৃতীর সঙ্গে বিরোধ বাধে অন্য এক গোষ্ঠীর দুষ্কৃতীদের। ফল, গুলিবিদ্ধ হয়ে এক যুবকের মৃত্যু। পরে অবশ্য চাপে পড়ে ওই দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার করে লালবাজার।
বিধাননগর পুরভোটের দিন টিভিতে ভোটের খবর দেখতে দেখতে চমকে উঠেছিলেন লালবাজারের গুন্ডাদমন শাখার কয়েক জন অফিসার। কারণ তাঁরা দেখলেন, সল্টলেকের বিভিন্ন এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুলিশের ‘ওয়ান্টেড’ তালিকায় নাম থাকা দক্ষিণ কলকাতার শেখ বিনোদ, কাশীপুরের আনোয়ার, বেলেঘাটার রাজু নস্কর-রবি নস্করের দলবল!
কাশীপুর এলাকায় বোমাবাজি-গুলির ঘটনায় শহরের একাংশ উত্তাল। অভিযোগ, শাসক দলের দুই গোষ্ঠীরই লড়াই হয়েছে সেখানে। তা নিয়ে বিব্রত লালবাজারের কর্তারাও। উপরমহল নির্দেশ দেয়, ওই দ্বন্দ্বে অপেক্ষাকৃত দুর্বল গোষ্ঠীর নেতাকে গ্রেফতার করে পরিস্থিতি শান্ত করতে হবে। কিন্তু বেঁকে বসে পুলিশের নিচুতলা। পাল্টা জানানো হয়, ঝামেলা থামাতে হলে দু’পক্ষকেই গ্রেফতার করতে হবে। শেষ পর্যন্ত দুই গোষ্ঠীর মাথাদের বাদ দিয়ে অভিযুক্ত চুনোপুঁটিদের গ্রেফতার করে আনে পুলিশ।
কেন থামে না গোলমাল?
পুলিশ সূত্রের খবর, কাশীপুর এলাকায় চুনোপুঁটি ধরপাকড় হলেও গোলমাল থামেনি। উল্টে দুই গোষ্ঠীর পাশাপাশি এখন মাথাচাড়া দিয়েছে তৃতীয় গোষ্ঠী! শুধু এলাকা দখলের ঝামেলা নয়, বাসিন্দাদেরও রীতিমতো সন্ত্রস্ত করে রেখেছে তৃতীয় গোষ্ঠীর লোকজন। পুজোর পরে তাদের নেতার বিরুদ্ধে কাশীপুর থানা এলাকার এক মহিলা শ্লীলতাহানি ও মারধরের অভিযোগ করেন। কিন্তু তার পরেও কার্যত চুপ পুলিশ। এলাকায় বহাল তবিয়তেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন ওই নেতা। তবে তদন্তকারীরা জানান, ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। অভিযোগের স্বপক্ষে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ চলছে।
পুলিশের একটি বড় অংশ বলছে, চাপে পড়ে উপরতলার কর্তারা যে ভাবে শহরের এই দুষ্কৃতীরাজকে বাড়তে দিচ্ছেন, তাতে আগামী দিনে আরও বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে। বাস্তবে দেখাও যাচ্ছে, কলকাতার যে কোনও গোলমালেই গুলি চলছে, বোমা পড়ছে। থানা-পুলিশকেও কার্যত রেয়াত করছে না গুন্ডারা। প্রতিটি ঘটনাতেই অভিযোগের আঙুল উঠছে শাসক দলের ‘নিয়ন্ত্রণে’ থাকা ওই দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধেই। পুলিশের একাংশ বলছেন, পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, রবিবার রাতে গড়িয়াহাট থানার টহলদার পুলিশকর্মীদের সামনেই বোমা ছুড়ে মারে দুষ্কৃতীরা। হরিদেবপুরের কবরডাঙাতেও একই ধরনের ঘটনা দেখা গিয়েছিল।
ক্রাইম বৈঠক এবং...
পুলিশকর্তাদের কেউ কেউ অবশ্য নিচুতলার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলছেন, নিচুতলার অভিযানে কখনওই বাধা দেওয়া হয় না। ক্রাইম কনফারেন্সে বেআইনি অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন খোদ পুলিশ কমিশনার। তার পরেও কি গোয়েন্দারা সব অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করতে পেরেছেন? ‘‘যদি ধরপাকড় ঠিক মতো হত, তা হলে কি রোজ রোজ শহরে গুলি চলত?’’ প্রশ্ন অন্য এক পুলিশকর্তার।
গোষ্ঠীবাজি রুখবে কে?
পুলিশ ও রাজনৈতিক দলগুলির একাধিক সূত্র বলছে, এলাকায় দাপট বজায় রাখা নিয়ে শহরের বিভিন্ন এলাকাতেই শাসক দলের একাধিক গোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে স্থানীয় নেতাদের ছাতার তলায় আশ্রয় নিচ্ছে দুষ্কৃতীরা। অন্য দল থেকেও এই আনাগোনা রয়েছে। যেমন কাশীপুরের তৃতীয় গোষ্ঠীর নেতা।
শাসক তৃণমূলেরই একটি সূত্র বলছে, বিভিন্ন ছোট দলে ঘোরাফেরা করে শেষে তৃণমূলে এসে ভিড়েছেন ওই নেতা। তাঁকে মদত দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে শাসক দলের এক কাউন্সিলর ও বিধায়কের বিরুদ্ধে। সেই কারণেই কাশীপুর এলাকার যুযুধান স্বপন চক্রবর্তী ও আনোয়ার গোষ্ঠীর পাশাপাশি নিজের দলবল জুটিয়ে ওই নেতা তৈরি করেছেন তৃতীয় গোষ্ঠী। অভিযোগ, দাপুটে নেতা-নেত্রীদের মদত থাকার ফলেই পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছেন তিনি।
লালবাজারের অফিসারেরা জানাচ্ছেন, তিলজলার ঘটনায় ধৃত মধ্য কলকাতার ওই দুষ্কৃতী মাস্টারের পিছনেও স্থানীয় এক কাউন্সিলরের মদত রয়েছে। জোড়াসাঁকো-কলাবাগান এলাকায় একাধিক গোলমালের ঘটনায় ওই নেতার লোকজনদের নাম জড়ালেও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি পুলিশ।
গোয়েন্দাদের আক্ষেপ, শুধু জোড়াসাঁকো নয়, শহর জুড়ে স্থানীয় ওই সব নেতাদের ভয়ে পুলিশের শীর্ষ কর্তারা এমন আঁতকে ওঠেন যে, দুষ্কৃতীরা সব সীমা পার করে যায়। যে কারণে জোড়াসাঁকো এলাকার মস্তান গিয়ে কড়েয়ায় বেপরোয়া গুলি চালাতে পারে, জানাচ্ছেন তাঁরা।
এই প্রসঙ্গেই ফের সামনে এসেছে পুরসভা ভোটে গিরিশ পার্কে পুলিশের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা। নিজেদের সহকর্মী পুলিশ অফিসার গুলি খাওয়ার পরে ধরপাকড়ে নামে গুন্ডাদমন শাখা। মাফিয়া ডন গোপাল তিওয়ারির বাড়িতে সন্ধান মেলে অস্ত্রাগারের। লালবাজারের অন্দরের খবর, এই অস্ত্রাগারের কথা স্থানীয় থানা এবং গুন্ডাদমন শাখার অফিসারদের একাংশ জানতেন। কিন্তু শাসক দলের এক দাপুটে নেতা ও বিধায়কের ছাতাই আগেভাগে গোপালকে ধরতে দেয়নি। গিরিশ পার্ক-কাণ্ডের পরে গোপালের সঙ্গে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের ছবিও সামনে এসেছিল। তা নিয়ে বিব্রত হয়েছিল শাসক দল।
চার্জশিটে নাম নেই
বড় ধরনের ঘটনা ঘটায় গোপাল তিওয়ারি, মধ্য কলকাতার দুষ্কৃতী মাস্টার-মিস্টার, হরিদেবপুরের কালী-দুর্গা গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু পুলিশ এদের পিছনে থাকা নেতাদের ধরা তো দূর, জিজ্ঞাসাবাদও করেনি। চার্জশিটেও কোনও গোলমালের পিছনে রাজনৈতিক গোলমালের কথা বলা হয়নি। লালবাজারের একাংশ জানাচ্ছে, গিরিশ পার্ক কাণ্ডে গোপালের দলবল কেন হামলা করেছিল, তা তো দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। তা সত্ত্বেও সেই মদতদাতার নাম চার্জশিটে উঠে আসেনি। পুলিশের একটা বড় অংশের আশঙ্কা, এই মদতদাতাদের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে শহরের গুন্ডারাজ বন্ধ হবে না। কিন্তু সেটা কি পারবে লালবাজার?