আত্মরক্ষা: ডাক্তারি পড়ুয়াদের তাইকোন্ডো প্রশিক্ষণ চলছে এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ফাইল চিত্র
মারের বদলা মার!
পরিকাঠামোর যথাযথ ব্যবস্থা থাক বা না থাক, পাল্টা মার দিতে শিখলেই হল! তা হলেই হাসপাতাল চত্বরে যে কোনও উত্তেজনা সামাল দেওয়া যাবে! এটাই কি স্বাস্থ্য দফতরের নয়া নীতি? কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বুধবারের ঘটনার পরে এই প্রশ্নই ফের সামনে আসছে। সম্প্রতি সরকারি ডাক্তারদের আত্মরক্ষার জন্য তাইকোন্ডো শেখার পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। অভিযোগ, বুধবার মেডিক্যালে যখন পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করতে শুরু করে, তখন তাইকোন্ডো না হোক, মৃতের উত্তেজিত পরিজনদের আলাদা ডেকে নিয়ে গিয়ে জুনিয়র ডাক্তারেরা তাঁদের নিগ্রহ করেন বলে অভিযোগ। তাতেই পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন উঠেছে, যেখানে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে বহু সময়েই জীবনদায়ী ওষুধ বা অক্সিজেন মজুত থাকে না, যেখানে পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক না-থাকায় মার খায় চিকিৎসা, যেখানে এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে ঠোক্কর খেতে খেতে মৃত্যু হয় রোগীর, সেখানে এই সমস্ত সমস্যার সমাধান না করে চিকিৎসকদের আত্মরক্ষার কসরত শিখতে উৎসাহী করে তুললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে না তো?
চিকিৎসকদের সংগঠন ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম’-এর তরফে চিকিৎসক রেজাউল করিম বলেন, ‘‘কোনও সভ্য ব্যবস্থায় দাদাগিরি চলে না। পরিকাঠামোর উন্নতি করতে হবে। হাসপাতালের সার্বিক সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য রোগী কল্যাণ সমিতি চিকিৎসক ও রোগীর পরিজনদের মধ্যে নিয়মিত বৈঠকের ব্যবস্থা করে না কেন?’’ তাঁর মতে, পরিকাঠামোগত ত্রুটি ঢাকতেই চিকিৎসকদের ‘শত্রু’ হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন রাজনৈতিক নেতারা। তিনি বলেন, ‘‘জুনিয়র ডাক্তারদের সামনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসেবে মার্শাল আর্ট তুলে ধরাটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। পরিকাঠামোর উন্নতি, চিকিৎসকদের আত্মসমালোচনা করার সুযোগ তৈরি হলে তবেই রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কে পরিবর্তন ঘটবে।’’
জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশ আবার মনে করেন, জরুরি বিভাগে পরিকাঠামোর উন্নতির পাশাপাশি রোগীর পরিজনদের সঙ্গে ঠিক ভাবে কথা বলার দক্ষতাই হয়ে উঠতে পারে তাঁদের নিরাপত্তার রক্ষাকবচ। তাঁদের সংগঠন ‘জুনিয়র ডক্টর্স ইউনিটি’র নেতা কবিউল হকের প্রশ্ন, বক্ষ রোগের চিকিৎসা করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা জরুরি বিভাগে থাকবে না কেন? পরিকাঠামো না থাকলে জরুরি বিভাগের দায়িত্বে থাকা জুনিয়র ডাক্তারেরা কী করবেন? তাঁর কথায়, ‘‘তাইকোন্ডো শিখে কখনও জুনিয়র ডাক্তারেরা নিরাপদ হবেন না। বরং সমস্যা বা়ড়বে। সব সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসার সুব্যবস্থা থাকলে সেটাই জুনিয়র চিকিৎসকদের নিরাপত্তার হাতিয়ার হবে।’’
মেডিক্যাল কাউন্সিলের নিয়ম অনুযায়ী, সমস্ত মেডিক্যাল কলেজে পড়ুয়াদের জন্য খেলাধুলো ও যোগাভ্যাসের ব্যবস্থা করতে হয়। চিকিৎসকদের আর এক সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেল্থ সার্ভিস ডক্টর্স’-এর নেতা, চিকিৎসক মানস গুমটার মতে, কোনও মেডিক্যাল কলেজ তাইকোন্ডো শেখাতেই পারে। কিন্তু সেটা কখনও রোগীর পরিজনদের উত্তেজনা ঠেকানোর হাতিয়ার হতে পারে না।
ডাক্তারদের তাইকোন্ডো শিখতে উৎসাহী করেছিলেন স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্য। এই বিতর্ক সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য, ‘‘তাইকোন্ডো শেখা মানে মারামারিকে প্রশ্রয় দেওয়া নয়। এই প্রশিক্ষণ মানসিক ভাবে দৃঢ় তৈরি করে। যে কোনও কঠিন পরিস্থিতিতে নিজেকে স্থির রাখার সাহস জোগায়। আবার একই সঙ্গে আত্মরক্ষা করতেও শেখায়। আত্মরক্ষার অধিকার তো সকলেরই রয়েছে।’’ পরিকাঠামোর উন্নতি প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘উন্নতির কোনও শেষ হয় না। গত কয়েক বছরে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে পরিকাঠামোর কতটা উন্নতি হয়েছে, সেটা সকলেই দেখতে পাচ্ছেন। আরও উন্নতি হবে।’’