সোজা পথে।এন্টালি এলাকায়। — নিজস্ব চিত্র
রক্তদান ব্যবসা নয়। এই কথাটা রক্তদান শিবিরের আয়োজকদের বোঝাতে শেষ পর্যন্ত আঙুল বাঁকানোর সিদ্ধান্ত নিল স্বাস্থ্য দফতর।
সরকারি-বেসরকারি সব ব্লাড ব্যাঙ্ককেই স্বাস্থ্য ভবন জানিয়ে দিয়েছে, যেখানে রক্তদানের বিনিময়ে উপহার দেওয়া হবে, সেই শিবিরে যেন তারা যোগ না দেয়। বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কগুলির লাইসেন্স অন্যথায় বাতিল হতে পারে। শাস্তির মুখে পড়তে পারেন সরকারি ব্লাড ব্যঙ্কের সংশ্লিষ্ট কর্মীরাও।
রক্তদান শিবিরে উপহার দেওয়ার বিষয়ে রাজ্যজুড়ে প্রচার চালানোর সিদ্ধান্তও স্বাস্থ্য ভবন নিয়েছে। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, এ বার প্রতিটি রক্তদান শিবিরে আয়োজক, উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্রচারপত্র বিলি করবেন স্বাস্থ্য দফতরের কর্মীরা। প্রয়োজনে কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে এই কাজে নিয়োগ করার কথা ভাবা হচ্ছে। কিছু দিন ধরেই অভিযোগ উঠছে, বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থার কাছ থেকে মোটা টাকা আদায় করে নানা এলাকায় ঘটা করে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করছে বেশ কিছু সংগঠন। আবার ওই একই ক্যাম্পের নাম করে এলাকা থেকেও দেদার টাকা তোলা হচ্ছে। তার পরে সেই রক্ত বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কে বিক্রি করা হচ্ছে। যাঁরা রক্ত দিচ্ছেন, তাঁদের মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে সুটকেস, মিক্সি, রাইস কুকার পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে। শিবির-বাবদ সংগ্রহ করা টাকার একটা বড় অংশ যেমন উদ্যোক্তাদের পকেটে ঢুকছে, তেমন রক্ত বিক্রির টাকাও যাচ্ছে তাদের ভাঁড়ারেই।
স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘রক্তদানের ব্যবসা এতটাই লাভজনক হয়ে উঠেছে যে প্রভাবশালী ক্লাব বা সংস্থাগুলি অপেক্ষাকৃত কম প্রভাবশালীদের শিবির করতেই দিচ্ছে না।’’ আর্থিক সামর্থ্য না থাকা ছোট ক্লাবগুলি উপহারের ব্যবস্থা না করতে পারায়, তাদের শিবির মার খাচ্ছে। এ রাজ্যে যখন রক্তের আকাল ভয়াবহ আকার নিচ্ছে, তখন এই প্রবণতা ঠেকাতে না পারলে তা স্বাস্থ্য পরিষেবাকে আরও বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে বলে ভয় পাচ্ছেন তাঁদের অনেকেই।
স্বাস্থ্যকর্তারা জানাচ্ছেন, রক্তদানের পরে দাতাদের একটি কার্ড দেওয়া হয়। পরে ওই কার্ড দেখিয়ে তাঁরা নিজেদের প্রয়োজনে বিনামূল্যে রক্ত পেতে পারেন। ইদানীং ওই উপহারের রক্তদান শিবিরগুলিতে রক্তদাতাদের কোনও কার্ডই দেওয়া হচ্ছে না। ওই সব শিবিরে দামি উপহার পেয়ে রক্তদাতারাও খুশি মনে কার্ড না নিয়েই চলে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এ ব্যাপারে একাধিক অভিযোগ জমা পড়ে। তার পরেই স্বাস্থ্য দফতরকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি।
কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ, স্বেচ্ছায় রক্তদানের বিনিময়ে কোনও টাকা বা মূল্যবান উপহার দেওয়া আগাগোড়াই নিষিদ্ধ। কারণ, মূল্যবান উপহার মানুষকে রক্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাবিত করলে বিপদ হতে পারে। আরও বলা হয়েছে, দামি উপহার রক্তদানের শর্ত হতে পারে না। তা হলে কী দেওয়া যেতে পারে? তারও উল্লেখ রয়েছে ওই নির্দেশিকায়। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, ‘‘টি-শার্ট, ব্যাজ, মেডেল, পেন আর কিছু স্বাস্থ্যকর খাবার। মূল্যবান উপহার যেমন রক্ত গ্রহীতার ক্ষতি করতে পারে, তেমনই ক্ষতি করতে পারে রক্তদাতারও। কারণ উপহারের লোভে শারীরিক ঝুঁকির দিক থাকলে বা কোনও রোগ থাকলেও, তা গোপন করছেন অনেকে।’’
সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কের অধিকর্তা কুমারেশ হালদার বলেন, ‘‘আমরা সব সময়েই উপহারের বিপক্ষে। এ নিয়ে প্রচারও চলে। কেউ মানে। কেউ মানে না। আমাদের সামনে উপহার না দিয়ে অনেকে লুকিয়ে দেয়। ব্যাপারটা চোর-পুলিশ খেলার মতো হয়ে যায়। মানুষকেই আরও সচেতন হতে হবে। আমরা এ নিয়ে আরও সতর্ক হচ্ছি।’’
বেসরকারি একটি ব্লাড ব্যাঙ্কের এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘যাঁরা রক্ত দানের আয়োজন করেন, অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের মাথা এমন প্রভাবশালী যে, প্রতিবাদ করার সাহসই থাকে না।’’ ওই কর্তা আরও বলেন, ‘‘উপহার থাকলে রক্তদান শিবির বয়কট করার যে কথা রাজ্য সরকার বলছে, তা নিঃসন্দেহে ভাল। কিন্তু আমাদের যে কর্মীরা রক্ত নিতে যাবেন, তাঁদের নিরাপত্তার দিকও সুনিশ্চিত করতে হবে রাজ্য সরকারকে।’’
এই অবস্থার মধ্যেই কিছু কিছু সংগঠন উপহারের বিনিময়ে রক্তদানের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। মধ্য কলকাতার এমনই একটি ক্লাব আয়োজিত রক্তদান শিবিরে আগাম ঘোষণা হয়েছে যে সেখানে তাঁরা কোনও উপহার দিচ্ছেন না। এমনই একটি ক্লাবের কর্তা সুবীর পান বলেন, ‘‘এখন তো স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবির হয় না। উপহারের লোভে হয়। তাই বলে রাখছি, কিছুর আশায় আসবেন না। আমরা বহু বছর ধরে রক্তদান শিবির করছি। কখনও ভাবিনি, এমন বিজ্ঞপ্তি করতে হবে।’’
রক্তদান আন্দোলনের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত কর্মী দীপঙ্কর মিত্র বলেন, ‘‘উপহারের বিষয়টা এখন যে পর্যায়ে গিয়েছে, তা রক্ত বিক্রির নামান্তর। দাতা-গ্রহীতা উভয়ের পক্ষেই ক্ষতিকর। এখনই রাশ না টানলে ভবিষ্যতে নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন বলে কিছু থাকবে না।’’