চিকেন পক্স (জলবসন্ত) রোগে মৃত্যুর হার বাড়ায় উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে। প্রতীকী ছবি।
করোনা, ডেঙ্গির পর্ব কাটিয়ে এ বার কি চোখ রাঙাবে চিকেন পক্স (জলবসন্ত)?
সাম্প্রতিক সময়ে এই রোগে মৃত্যুর হার বাড়ায় উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে বলেই জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। পাশাপাশি তাঁরা এ-ও জানাচ্ছেন, সংক্রামক এই রোগে এ বার বয়স্করাই সব চেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে স্বাস্থ্যকর্তাদের কপালেও। তাই শুক্রবার বেলেঘাটা আইডি হাসপাতাল থেকে রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য ভবন। এ দিন স্বাস্থ্য দফতরের জনস্বাস্থ্য বিভাগের চার জন প্রতিনিধির একটি দল আইডি-তে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন। সংক্রামক ওই রোগের চিকিৎসার উৎকর্ষ কেন্দ্র হচ্ছে আইডি। স্বাস্থ্য অধিকর্তা সিদ্ধার্থ নিয়োগী বলেন, ‘‘আবহাওয়ার পরিবর্তনের সময়ে এই রোগের প্রকোপ বাড়ে। তবে এ বারের পরিস্থিতির উপরে নজর রাখা হচ্ছে।’’
এ দিন দুপুরের মধ্যেই ওই হাসপাতাল থেকে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে স্বাস্থ্য দফতরে। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি, এই তিন মাসে বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। জানুয়ারিতে মৃতের সংখ্যা সব থেকে বেশি। আবার, গত ১ নভেম্বর থেকে এ দিন পর্যন্ত ওই হাসপাতালে ভর্তি জলবসন্তে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৫৮। যাঁদের মধ্যে এ দিন বিকেল পর্যন্ত চিকিৎসাধীন রয়েছেন সাত জন। তাঁদের মধ্যে দু’জনের অবস্থা সঙ্কটজনক। আবার শেষ তিন মাসে যে ক’জনের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের ৫০ শতাংশের বয়স পঞ্চাশের উপরে। তাঁদের মধ্যে পুরুষ ৭৫ শতাংশ এবং মহিলা ২৫ শতাংশ।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, যে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের ৬০ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, ক্যানসার, সিওপিডি, হেপাটাইটিস-বি, ডায়াবিটিস, ইমিউনোসাপ্রেসিভ থেরাপি, হৃদ্রোগের মতো কোমর্বিডিটি ছিল। এ ছাড়া, এসএসকেএম ও এম আর বাঙুর থেকে দু’জন রোগী আইডি-তে এসেছেন একেবারে শেষ সময়ে। হাসপাতালে আসার কিছু ক্ষণ পরেই তাঁদের মৃত্যু হয়। মৃতদের মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশেরই ভর্তির সময়ে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কম ছিল। আর যত জন ভর্তি হয়েছেন, তাঁদের ৫০ শতাংশ আক্রান্ত হওয়ার ৪ থেকে ৭ দিনের মধ্যে হাসপাতালে এসেছেন।
আইডি হাসপাতালের বক্ষরোগ চিকিৎসক কৌশিক চৌধুরীর কথায়, ‘‘দেরি করা আসা খুবই বিপজ্জনক। অধিকাংশ রোগী যখন হাসপাতালে এসেছেন, তত ক্ষণে চিকেন পক্স নিউমোনিয়ায় ফুসফুস মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গিয়েছে। তাতে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ক্রমশ কমেছে।’’ তবে এ বার জলবসন্তে মৃতের সংখ্যা বেশি হওয়ার নেপথ্যে কোভিড পরবর্তী কারণ রয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে জানাচ্ছেন তিনি। তবে, কোভিড-বিধি কার্যত উঠে যাওয়ার কারণেও এই সংক্রমণ মাথাচাড়া দিচ্ছে বলে মত আইডি-র মাইক্রোবায়োলজির বিভাগীয় প্রধান আশিস মান্নার। তাঁর কথায়, ‘‘জল ফোস্কা ফেটে তার রস লেগে অন্য জন আক্রান্ত হতে পারেন। আবার, হাঁচি, কাশির জলকণা থেকেও এই রোগ ছড়ায়। কোভিড-বিধি মেনে চললে চিকেন পক্সও প্রতিরোধ করা সম্ভব।’’
ভ্যারিসেলা জ়স্টার (ভি-জ়েড) ভাইরাসের কারণেই জলবসন্তে আক্রান্ত হয় মানুষ। সংক্রামক রোগের চিকিৎসক যোগীরাজ রায়ের কথায়, ‘‘সাধারণত কমবয়সিদের মধ্যেই এটি বেশি দেখা যায়। তবে বয়স্ক ও কোমর্বিডিটি রয়েছে, এমন মানুষেরা জলবসন্তে আক্রান্ত হলে ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।’’ করোনার থেকেও চিকেন পক্সের ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা বেশি বলে জানাচ্ছেন জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক অনির্বাণ দলুই। তিনি বলেন, ‘‘বাড়িতে এক জনের হলে অন্যদের সংক্রমিত হওয়ার প্রভূত আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে শুধু জ্বর ও শরীরে র্যাশ বার হয়, তেমনটা নয়। এটি মূলত শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাতে জলবসন্তে আক্রান্তের অন্য ভাইরাস বা ব্যাক্টিরিয়ার দ্বারা দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ (সেকেন্ডারি ইনফেকশন) হলে তা মারাত্মক হতে পারে।’’ সাধারণত বাচ্চাদের হাম, মাম্পস ও বসন্ত হয়। কিন্তু সেটা বড়দের হলে তা মারাত্মক হওয়ার আশঙ্কাই বেশি থাকে বলে মত কৌশিকের।