পাভলভের লন্ড্রিতে কাজ করছেন সুস্থ হওয়া রোগীরাই। — ফাইল চিত্র
হাসপাতালে তাঁরা অকারণ শয্যা আটকে থাকেন। আবার ঘরেও তাঁদের ঠাঁই হয় না। আক্ষরিক অর্থেই এই ‘যে জন আছে মাঝখানে’-দের জন্য এ বার বিশেষ প্রকল্প নিল স্বাস্থ্য দফতর। রাজ্যে এই প্রথম মানসিক হাসপাতালে তৈরি হতে চলেছে ‘হাফ ওয়ে হোম’। সেরে ওঠা মানসিক রোগীরা এখানে স্বাধীন ভাবে বাঁচার সুযোগ পাবেন। তাঁদের জন্য থাকবে নানা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণও। স্বনির্ভর হওয়ার পরে তাঁরা চাইলে ওই হোম থেকে বেরিয়ে নিজেদের মতো করে অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করতে পারবেন। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, প্রাথমিক ভাবে কলকাতার পাভলভ হাসপাতালে প্রথম এই হোম খোলার কথা ভাবা হয়েছে।
হাসপাতালে থাকার মতো অসুস্থ যাঁরা নন, আবার বা়ড়িতেও যাঁদের ঠাঁই হয় না, তাঁদের নিয়ে মানসিক হাসপাতালে টানাপড়েন বরাবরের। মূলত এই সমস্যার কারণেই সরকারি মানসিক হাসপাতালে যত শয্যা বরাদ্দ, প্রায় সব সময়েই তার দ্বিগুণ বা তারও বেশি রোগী থাকেন। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই পরিস্থিতি বসবাসের অযোগ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই পরিস্থিতিতে সেরে ওঠা মনোরোগীদের পুনর্বাসনের জন্য ভাবনাচিন্তা চলছিল বহু বছর ধরেই। এত দিনে তা চূড়ান্ত হল।
রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, ‘‘কয়েক মাসের মধ্যেই এই হাফ ওয়ে হোম চালু হবে। বাড়ি যাঁদের ফিরিয়ে নেয় না, তাঁরা থাকবেন সেখানে। কত দিন থাকবেন, তার কোনও মেয়াদ নির্দিষ্ট নেই। ওই হোমে ওঁদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। আমাদের উদ্দেশ্য, পরনির্ভরতা কাটিয়ে ধাপে ধাপে ওঁদের পুরোপুরি সমাজের মূল স্রোতে ফেরানো।’’
বস্তুত, মানসিক রোগীদের পুনর্বাসন নিয়ে কথা হয় বিস্তর। কিন্তু তা কাজে করে দেখানোর নজির নেহাতই কম। সম্প্রতি পাভলভে সেরে ওঠা মানসিক রোগীদের জন্য বিশেষ জীবিকার ব্যবস্থা করেছে স্বাস্থ্য দফতর। একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে হাসপাতালের জমিতেই গড়ে উঠেছে লন্ড্রি। সেরে ওঠা মনোরোগীরাই সেখানে কাজ করছেন। তাঁদের জন্য ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। উপার্জনের অর্থ জমা পড়ছে সেখানেই। হাফ ওয়ে হোম সেই উদ্যোগকেই আরও খানিকটা প্রসারিত করল বলে মনে করছেন স্বাস্থ্যকর্তাদের একটা বড় অংশ।
এ রাজ্যে কাগজে-কলমে কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা মনোরোগীদের জন্য হাফ ওয়ে হোম চালায়। কিন্তু কার্যত তার পরিবেশ যে কোনও মানসিক হাসপাতালের মতোই। তা ছাড়া, ওই হোমগুলিতে থাকার জন্য যথেষ্ট মোটা অঙ্কের অর্থই খরচ করতে হয় পরিজনদের। পরিবারের লোকজন যাঁদের অস্তিত্বই স্বীকার করে না, তাঁদের জন্য খরচ করতেও আগ্রহী থাকে না বহু ক্ষেত্রেই। ফলে ঠাঁই না হওয়া মানুষের সংখ্যাই বেশি ওই হাফ ওয়ে হোমগুলিতে। সরকারি হাফ ওয়ে হোমে সেই খরচের সমস্যাটি থাকবে না।
বিষয়টিকে খুবই জরুরি বলে মনে করছেন মনোরোগ চিকিৎসকেরাও। জাতীয় স্তরের মানসিক হাসপাতাল রাঁচির ইনস্টিটিউট অফ নিউরো সাইকিয়াট্রি অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেস (রিনপাস)-এর চিকিৎসক মসুর জাহান বলেন, ‘‘সেরে ওঠা মানসিক রোগীদের এ ভাবে পুনর্বাসনের দায়িত্ব সমাজের। সমাজ সেই দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ বলেই সরকারকে দায়িত্ব নিতে হচ্ছে।’’ তিনি জানান, রিনপাসে এ ধরনের একটি হাফ ওয়ে হোম চালু করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সে জন্য আলাদা বাড়িও তৈরি হয়। কিন্তু তার পরে লোকাভাবে সেটি চালু করা যায়নি।
প্রশ্ন উঠেছে, সরকারি হাসপাতালে কর্মীর অভাব যেখানে এ রাজ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবাকে নানা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাচ্ছে, সেখানে কোন ভরসায় এমন নতুন একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে চলেছে রাজ্য সরকার? স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, এই প্রকল্পে নতুন নিয়োগের কথা ভাবা হয়েছে। প্রয়োজনে চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ হবে। তা ছাড়া মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি এই প্রকল্পে সহায়তা করবে। তাই কর্মীর অভাব এ ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হবে না।
এমনই এক সংগঠনের তরফে রত্নাবলী রায় বলেন, ‘‘আমরা একে হাফওয়ে হোম বলতে রাজি নই। আমরা বলছি, ‘সাপোর্টেড লিভিং’। একজন মানুষ দৈনন্দিন জীবনে যে অধিকারগুলি নিয়ে বেঁচে থাকেন, তাঁকে সে গুলি দেওয়া নিশ্চিত করার চেষ্টা হবে। আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সেরে ওঠার পরেও মাসের পর মাস হাসপাতালের ওয়ার্ডে অন্য মনোরোগীদের সঙ্গে থাকতে থাকতে অনেকেই ফের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এই অভিজ্ঞতা অত্যন্ত যন্ত্রণার। এই প্রকল্পটি সফল হলে বহু মানুষ তাঁদের অধিকার নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবেন।’’