গল্ফগ্রিন

হাতের কাছে বাজার নেই, বড্ড জলও জমে

উত্তরের মেয়ে এসে দক্ষিণে পড়লে যা হয়! ৮০-র দশকের গল্ফগ্রিন। সবুজে মোড়া পাড়াটায় তখন রাত হলেই শিয়াল ডাকে। আর বৃষ্টি পড়লেই ব্যাঙের ডাক। কেমন একটা লাগত, মনে হতো আমার এ বাড়িতে বুঝি কেউ আসতেই চাইবে না! সেই গল্ফগ্রিনকেই বড্ড ভালবেসে ফেললাম। নিরিবিলি, গাড়িঘোড়ার ভিড় কম, গাছে ঘেরা চওড়া রাস্তা। শব্দ, ধুলো, ধোঁয়া সবটাই অনেক অনেক কম।

Advertisement

হৈমন্তী শুক্ল

শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৫ ০০:০৩
Share:

উত্তরের মেয়ে এসে দক্ষিণে পড়লে যা হয়!
৮০-র দশকের গল্ফগ্রিন। সবুজে মোড়া পাড়াটায় তখন রাত হলেই শিয়াল ডাকে। আর বৃষ্টি পড়লেই ব্যাঙের ডাক। কেমন একটা লাগত, মনে হতো আমার এ বাড়িতে বুঝি কেউ আসতেই চাইবে না! সেই গল্ফগ্রিনকেই বড্ড ভালবেসে ফেললাম। নিরিবিলি, গাড়িঘোড়ার ভিড় কম, গাছে ঘেরা চওড়া রাস্তা। শব্দ, ধুলো, ধোঁয়া সবটাই অনেক অনেক কম। তুমুল গরমেও ছায়াঘেরা আরাম, আলো-হাওয়ায় খোলামেলা। শোভাবাজার-বাগবাজারের সেই ট্রামের শব্দে ঘুম ভাঙা পাড়ার চেয়ে একেবারে আলাদা। তিরিশ বছর পেরিয়ে এই গল্ফগ্রিনই আমার ‘হোম সুইট হোম’। অন্য কোথাও থাকতেই পারি না!
অনেকটা সবুজ। সেটাই সবার আগে মন কেড়েছিল এখানে। বড় বড় গাছপালায় ঘেরা পথ, খোলা মাঠ, পার্ক। আর সবটাই দেখভাল করা হয় খুব ভাল ভাবে। চারপাশটা তাই বেশ সতেজ সবুজ। পার্কগুলোতে বাচ্চারা নিয়মিত খেলাধুলো করে। বয়স্করা হাঁটেন, গল্প করেন। এর বাইরে অন্যদের অবশ্য তেমন সময় নেই। বিকেলটুকুর বাইরে তাই ফাঁকাই পড়ে থাকে পার্ক।

Advertisement

গল্ফগ্রিনে থাকতে শুরু করেছিলাম ১৯৮২ থেকে। এই আবাসনে এসেছি সেই ১৯৮৭-এ। এখান থেকেই একটু একটু করে ভাললাগাটা বেড়েছে। লোকজনও বেশ ভাল। কেউ কেউ অবশ্য ততটা ভাল নন, ঝামেলাও লেগে যায় কারও কারও সঙ্গে। তবে একসঙ্গে থাকতে গেলে একটু ঠোকাঠুকি তো লাগেই! নববর্ষ, দোল, বিজয়া, উপলক্ষ পেলেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। বড়রা, বাচ্চারা সবাই মিলে হইচই করে। একটা বাঁধানো স্টেজ আছে। অনুষ্ঠান হয় সেখানেই। তবে আজকাল দেখি, বাচ্চাদের মধ্যে যেন পশ্চিমি সংস্কৃতির প্রভাবটা যেন বেশি। এটা একটু দুঃখ দেয় নিশ্চয়ই। তবে সে তো এখন সর্বত্রই। একা গল্ফগ্রিনের দোষ বলি কী করে! তবু এখানে বেশ কিছু বাচ্চা এখনও বাংলা গান-নাচে দিব্যি যোগ দেয়। সেটাও তো পাওয়া।

ইদানীং জঞ্জাল সাফাইয়ের ব্যবস্থাটাও অনেক ভাল হয়েছে। কম্প্যাক্টর বসেছে। বিদেশের মতো সকালে রাস্তা ধোয়াও হয়। রাস্তাঘাট তাই বেশ সাফসুতরো, ঝকঝকে হয়ে থাকে। ভাঙাচোরা, এবড়োখেবড়োও নেই তেমন। ফাঁকা ফাঁকা রাস্তাগুলোতে আগে বেশ ছিনতাই হতো। চুরি-ডাকাতির ভয়ও পেত অনেকেই। সেই ভয়টা কিন্তু বেশ কমেছে। ছিনতাইও কমে গিয়েছে অনেক। রাত বাড়লেও নির্ভয়েই গল্ফগ্রিনের পথ দিয়ে যাতায়াত করা যায়।

Advertisement

তবে সমস্যা কি আর নেই?

যে সবুজ, যে খোলামেলা পরিবেশ গল্ফগ্রিনের চরিত্র, সেটাই যে একটু একটু করে নষ্ট হচ্ছে। বেশ কিছু ফ্ল্যাটবাড়ি, অফিস আকারে-বহরে বাড়তে গিয়ে চওড়া রাস্তা খানিক সরু হয়ে যাচ্ছে, গাছগাছালি কাটা পড়ছে। খোলামেলা গল্ফগ্রিনও একটু যেন ঘিঞ্জি হয়ে উঠছে। এ পাড়ায় আর যা-ই হোক, কংক্রিটের জঙ্গল হলে বড্ড কষ্ট পাব।

ইদানীং গভীর রাতে নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান করে বড্ড আওয়াজ করে মোটরবাইক ছুটিয়ে যায় ছেলেরা। এইটা যদি পুলিশ একটু বন্ধ করতে পারত! অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের একটা দলও মাঝেমধ্যে রাতদুপুরে অকারণ চেঁচামেচি জোড়ে। তাদের কারও কারও পোশাক-আশাকও বেশ গোলমেলে। এটা কিন্তু ঠিক আমার চেনা গল্ফগ্রিনের চরিত্র নয়। এগুলো বন্ধ হলেও ভাল লাগত। আর একটা ব্যাপার দেখি। গল্ফগ্রিনের রাস্তাটাকে বাইরের বহু লোক গাড়ি চালানো শেখার জায়গা ভেবে ফেলেন। কাঁচা হাতে গাড়ি চালাতে গিয়ে ছোটখাটো দুর্ঘটনাও ঘটিয়ে ফেলেন কেউ কেউ। এটাও কিন্তু বেশ বিরক্তিকর।

বড্ড জলও জমছে কিছু দিন হল। একটু বৃষ্টিতেই জলের তলায় চলে যাচ্ছে গোটা এলাকা। এখানকার নিকাশির দিকে পুরসভার কি তবে তেমন নজর নেই? আয়লার পড়ে রাস্তায় অতগুলো গাছ ভেঙে পড়েছিল। পরে তত গাছ আর বসানো হয়নি। সবুজ কমে গিয়েছে খানিক।

আর নেই বাজার। এখানে বেশির ভাগেরই নিজস্ব গাড়ি আছে। তাঁরা সকলেই লেক-মার্কেট, গড়িয়াহাট কিংবা শপিং মল-টলে চলে যান। কাছাকাছি রোজকার বাজার বলতে যাদবপুর বা বিজয়গড়। অগত্যা সেখানেই যাই। বড় রাস্তার ধারে সুপারমার্কেট হবে শুনেছিলাম।
জায়গা বাছাই হয়ে পড়ে আছে সেই কবে থেকে। গুটি কয়েক দোকান খুলেছে শুধু। আর কিছু এগোয়নি। এত বড় একটা পাড়া, রোজকার কেনাকাটার জন্য একটা বাজার থাকবে না!

তবু এই পাড়াটা ভাল। মানে খারাপ খুঁজে বার করাটা আমার পক্ষে একটু মুশকিল।

হ্যাঁ, উত্তরের মতো আড্ডা নেই, পাড়া-পড়শির সঙ্গে আত্মিক বন্ধন নেই, হট্টগোল নেই। এমনকী তেলেভাজাও নেই। এখানে লোকের সময় কম, পাশের বাড়ির মানুষের সঙ্গেও মনের যোগাযোগ নেই বললেই চলে। আর তেলেভাজার বদলে খালি রেস্তোরাঁর খাবার, নয়তো কেক-প্যাস্ট্রি। তবু ভাল লাগে।

ফেলে আসা উত্তরের সঙ্গে এখনও আমার প্রাণের টান। তবু ওই যে, বড্ড শান্তি। আসলে গানের মানুষ তো। শান্ত জায়গায় কাজটাও ভাল হয়, মন ভাল করা তো বটেই। গল্ফগ্রিনেও তাই প্রাণের টান কম কীসে!

ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement