ফাইল চিত্র।
রাজ্য সরকারের অর্থসঙ্কটের কথা একাধিক জায়গায় প্রকাশ্যে বলেছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। সরকারের অর্থের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে সরকারি হাসপাতালে নিখরচায় পরিষেবা দিতে। তাই হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতিতে অর্থের পরিমাণ কিছুটা বাড়াতে সেখানে স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে চিকিৎসায় জোর দিচ্ছে সরকার।
কিন্তু, বেশির ভাগ সরকারি হাসপাতালেই এখনও পর্যন্ত সেই চেষ্টা তেমন সফল হয়নি। কারণ হিসাবে যে প্রশ্নটা উঠে আসছে তা হল, এমনিতেই যেখানে নিখরচায় চিকিৎসা মেলে, সেখানে স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের টাকায় মানুষ পরিষেবা পেতে আগ্রহী হবেন কেন? বরং তাঁরা সেই কার্ডে বেসরকারি জায়গায় চিকিৎসা করাবেন।
তবু এরই মধ্যে চোখে পড়ার মতো সাফল্য এসেছে কলকাতার এসএসকেএম ও এন আর এস মেডিক্যাল কলেজে। রাজ্য সরকারি হাসপাতালগুলির মধ্যে স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে চিকিৎসা করে রোগী কল্যাণ সমিতিতে টাকার জোগান বাড়ানোর ক্ষেত্রে এই দুই হাসপাতাল রয়েছে যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০২১-এর ১ এপ্রিল পর্যন্ত এসএসকেএমে স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে চিকিৎসা করিয়েছেন প্রায় আট হাজার রোগী। তাদের রোগী কল্যাণ সমিতিতে এর ফলে বিমার প্রিমিয়ামের ১১ কোটি টাকা এসেছে। একই ভাবে এন আর এস স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে আট হাজার রোগীর চিকিৎসা করে রোগী কল্যাণ সমিতিতে জোগাড় করেছে ৮ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা। তাদের তুলনায় আর জি কর বা ন্যাশনাল মেডিক্যালের মতো শহরের হাসপাতাল এবং জেলারও অধিকাংশ সরকারি হাসপাতাল অনেকটাই পিছিয়ে। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ন্যাশনাল মেডিক্যাল এবং আর জি করে রোগী কল্যাণ সমিতির আয় কমে যাওয়ার পিছনে দায়ী সদিচ্ছার অভাব।
এসএসকেএম এবং এন আর এসে এই সাফল্যের চাবিকাঠি কী? এসএসকেএমের সুপার মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা প্রচারে ভীষণ জোর দিয়েছি। গোটা হাসপাতালে পোস্টার লাগানো হয়েছে। জানানো হয়েছে, স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে চিকিৎসা করালে দালালদের হাত থেকে বাঁচা যাবে। আইসিইউ-য়ে জায়গা পাওয়া বা দ্রুত অস্ত্রোপচারের তারিখ পাওয়াও সহজ হচ্ছে।’’
তিনি আরও জানান, ওয়ার্ডে ঘুরে রোগী সহায়কেরা খোঁজ নেন, কোন কোন রোগীর স্বাস্থ্যসাথী কার্ড রয়েছে। তার পরে তাঁদের কাউন্সেলিং করা হয়। স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে চিকিৎসা করালে ওষুধ বা দামি চিকিৎসা সামগ্রী দ্রুত পাওয়া এবং সরকারি জায়গাতেও কর্পোরেট ধাঁচের পরিষেবা পাওয়া যে সম্ভব, সে কথা জানানো হয়। স্বাস্থ্যসাথীতে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের কোথাও সমস্যা হচ্ছে কি না, সেই খোঁজও নেন রোগী সহায়কেরা। মণিময়বাবু জানালেন, এতে খুব ভাল ফল মিলেছে। গত এক বছরে করোনারি অ্যাঞ্জিয়ো-সহ কার্ডিয়োলজির অনেক কেস, কেমোথেরাপি, অর্থোপেডিক অস্ত্রোপচার, মেডিসিনের অনেক কেস স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে করা গিয়েছে।
নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তাঁরা সার্জারি বিশেষত অর্থোপেডিক সার্জারির ক্ষেত্রে সব সময়ে স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে ভর্তির উপরে জোর দিয়েছেন। কারণ, এমনি ভর্তি হলে অর্থোপেডিক ইনপ্লান্টের জন্য সরকারি টাকার ব্যবস্থা করে কিনতে দীর্ঘ সময় লাগে। স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে দ্রুত তা কেনা যায়, অস্ত্রোপচারও দ্রুত হয়। এন আর এসে হেমাটোলজির অনেক কেসেরও চিকিৎসা হয়েছে স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে।
সম্প্রতি সরকারি হাসপাতালে এলে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড দেখানো বাধ্যতামূলক হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্তাদের কথায়, ‘‘কার্ড দেখতে চাওয়া মানে কাউকে তাতে চিকিৎসা নিতে বাধ্য করা নয়। তবে ওই কার্ডে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করালে কী কী সুবিধা, সেটা বোঝানো হচ্ছে। তা ছাড়া এর ফলে কত জনের কার্ড রয়েছে, সেই তথ্যভান্ডারও তৈরি করা যাবে।’’
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, প্রথম ৬০ লক্ষ স্বাস্থ্যসাথী কার্ড ‘ইনশিয়োরেন্স মোড’-এ হয়েছিল। অর্থাৎ, সেগুলির জন্য সরকার বার্ষিক প্রিমিয়াম দেয় বিমা সংস্থাকে। এর পরে ১ কোটি ৪০ লক্ষ কার্ড হয়েছে ‘অ্যাশিয়োরেন্স মোড’-এ। এ ক্ষেত্রে কোনও বিমা সংস্থা নেই। যে রোগীর চিকিৎসায় যত খরচ, তা সরকার দিয়ে দেয় বেসরকারি হাসপাতালকে। তবে সরকারি হাসপাতালে কোনও টাকা দেওয়া হয় না। ফলে, প্রথম ৬০ লক্ষ কার্ড প্রাপকদের মধ্যে কেউ সেই কার্ডে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে তবেই সেখানকার রোগী কল্যাণ সমিতিতে বিমার টাকা জমা হবে।
রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করালে দামি চিকিৎসা সামগ্রী, দামি ওষুধ যেমন দ্রুত পাওয়া সম্ভব হবে, তেমনই ছুটির সময়ে রোগী ৫০০ টাকা এবং বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ওষুধও পেয়ে যাবেন।’’