অস্ত্রোপচার থেকে ওষুধ, কাগজ-কলমে সবটাই মেলার কথা বিনামূল্যে। তবু খরচের ভারে প্রাণ ওষ্ঠাগত রোগীর পরিজনেদের!
সরকারি হাসপাতালে নিখরচায় চিকিৎসা ব্যবস্থার ফাঁক নিয়ে ইতিমধ্যেই বহু অভিযোগ উঠেছে। রেফারের গেরো, দালাল-চক্রের দাপটে হাসপাতালে ভর্তি হতে না পারার নজির রয়েছে ভূরি ভূরি। যদি বা বেড মিলল, তার পরেও থেকে যায় চিকিৎসা সংক্রান্ত আরও খরচ। এতশত সামাল দিতে না পেরে অবসাদগ্রস্ত হওয়ার নজির আগেও মিলেছে। কেষ্টপুরের শম্ভুনাথ মণ্ডলের ঘটনা আবারও তা-ই দেখাল চোখে আঙুল দিয়ে।
শুক্রবার শহরের নানা হাসপাতালে ঘুরে দেখা গেল, খরচের ভারে নাজেহাল আরও বহু রোগীই। যেমন হাল গঙ্গানগরের বছর বিয়াল্লিশের বিশ্বনাথ পালের। বছর পাঁচেক আগে মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছে রং মিস্ত্রি বিশ্বনাথবাবুর। এনআরএসে অস্ত্রোপচার হয় তাঁর। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, পুরোপুরি সুস্থ হতে প্রয়োজন অস্ত্রোপচার পরবর্তী থেরাপি। সরকারি হাসপাতালে দীর্ঘদিন সেই থেরাপির সুযোগ পাননি। থেরাপি এবং ওষুধের খরচ চালাতে এখনও হিমশিম খাচ্ছেন স্ত্রী সবিতা পাল। পুরোপুরি সুস্থ হওয়া তো দূর অস্ত্, হাঁটাচলাও করতে পারেন না বিশ্বনাথবাবু। স্থানীয় একটি স্কুলে বাচ্চাদের দেখভালের কাজ করে মাসিক তিন হাজার টাকা আয় হয় সবিতাদেবীর। এ দিকে স্বামীর মাসিক চিকিৎসার খরচই প্রায় ছ’হাজার টাকা। এ দিন বিশ্বনাথবাবু বলেন, ‘‘মরে বেঁচে আছি।’’
সমস্যাটা বুঝছেন চিকিৎসকেরাও। ডাক্তারদের বক্তব্য, সরকারি ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য পরিষেবা বিনামূল্য ঘোষিত হলেও ‘আউট অব দ্য পকেট’ খরচ কমানো যাচ্ছে না। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে আবার ‘আউট অব দ্য পকেট’ খরচ কী?
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ভর্তি কিংবা ওষুধ পুরোপুরি নিখরচায় বলা হলেও বাস্তব ছবিটি আলাদা। সরকারি হাসপাতালে রোগীর অনুপাতে শয্যা সংখ্যা পর্যাপ্ত নেই। অনেক সময়ে ভর্তির জন্য রোগী দালালের সাহায্য নেন। কলকাতার একটি সুপার স্পেশ্যালিটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তির জন্য দশ থেকে বারো হাজার টাকাও ‘দাম’ ওঠে। ভর্তির পরেও প্রয়োজনীয় ওষুধ অনেক সময়েই সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে মেলে না। অত্যন্ত জরুরি কোনও ওষুধ বা ইনঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ স্টকে না থাকলে হাসপাতালের কর্মীরা রোগীর পরিজনেদের বাইরে থেকে কিনে আনতে বলেন।
এর বাইরেও রয়েছে বিশাল খরচের তালিকা। অধিকাংশ সময়ে সে সব চিকিৎসার খরচ বলে গণ্যই হয় না। কিন্তু সেই চাপ বহন করা রোগীর পরিজনদের কাছে বেশ কষ্টসাধ্য।
যেমন গুরুতর অসুস্থ রোগীর অস্ত্রোপচার পরবর্তী চিকিৎসা করার মতো পরিকাঠামো অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে নেই। অথচ একাধিক অসুখের চিকিৎসায় পুনর্বাসন খুব জরুরি। বিভিন্ন থেরাপি এবং চিকিৎসা তাই বাড়ি নিয়ে গিয়ে করাতে হয়। তা যথেষ্ট ব্যয়বহুল। ক্যানসার কিংবা স্নায়ুর সমস্যার মতো অসুখের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়। কিন্তু বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবার মধ্যে তা নেই। তা ছাড়া, অধিকাংশ হাসপাতালে রোগীর সঙ্গে পরিবারের কাউকে থাকতে হয়। তাঁরও থাকা-খাওয়ার খরচ আছে।
এই প্রসঙ্গে ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘একটা বড় সমস্যার খুব ক্ষুদ্র সমাধানের দিকে হাঁটছি আমরা। সবাইকে স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতে চাইলে সামগ্রিক আর্থসামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা করা খুব জরুরি।’’ হৃদ্রোগের চিকিৎসক সরোজ মণ্ডল বলেন, ‘‘যে কোনও উন্নত দেশে সামাজিক নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ। তা গুরুত্ব
না পেলে বিনামূল্যে হাসপাতালে ভর্তি এবং চিকিৎসক দিয়ে সমস্যা মিটবে না।’’
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্য অবশ্য রোগীর অধিকারের বিষয়ে সচেতনতার বিষয়টিতে জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় রোগীর কী কী অধিকার, সে সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি। কোনও পরিষেবা বিনামূল্যে না মিললে অভিযোগ জানানোরও জায়গা আছে।’’