দেশের বিমানে দেবারতি।
অবশেষে শুক্রবার দেশের বিমানে উঠতে পারলাম। তার আগে বৃহস্পতিবার রাতে ইউক্রেন থেকে সীমান্ত পেরিয়ে পোল্যান্ডে ঢুকতে পেরেছিলাম। টানা ন’ঘণ্টা তীব্র ঠান্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার সময়ে মনে হচ্ছিল, ওখানেই বুঝি মরে যাব। মাকে ফোন করে সে কথাই বলেছিলাম। ইউক্রেনীয় সেনার ছাড়পত্র পেয়ে বৃহস্পতিবার রাতেই ২০ জন ডাক্তারি পড়ুয়া রওনা দিয়েছিলাম পোল্যান্ডের বুদারিউমা সীমান্তের দিকে। অন্ধকারে হাঁটতে শুরু করার পরে দেখলাম, মানুষের দীর্ঘ লাইন এগিয়ে চলেছে। আমরাও ওই পথ ধরেছিলাম।
বুদারিউমায় পৌঁছনোর পরে আমাদের দায়িত্ব নেন ভারতীয় দূতাবাসের কর্মীরা। পাঁচতারা হোটেলে বিলাসবহুল ঘরে ঢুকে স্বস্তির শ্বাস নিলাম। ভাবার চেষ্টা করলাম, তা হলে কি অবশেষে ফিরতে পারছি হাওড়ার ইছাপুরের কামারডাঙার বাড়িতে? যেখানে বাবা-মা-ভাই গভীর উৎকণ্ঠায় রয়েছে, সেখানে? পোল্যান্ডে প্রবেশের পরেই দূতাবাসের অফিসারেরা পাসপোর্ট নিয়েছিলেন। শুক্রবার দিনের প্রথম উড়ানে নাম ছিল না। সন্ধ্যায় উৎকণ্ঠার অবসান হয়।
সীমান্তে পৌঁছনোর পরে দূতাবাসের তরফে যা সাহায্য করা হচ্ছে, তা আশাতীত। কিন্তু খারকিভ থেকে পোল্যান্ড— এই দীর্ঘ পথে দূতাবাসের সাহায্য পাইনি। অথচ ভেবেছিলাম, খারকিভ থেকেই সাহায্য পাব। খারকিভের বোজকল স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠার ২৪ ঘণ্টা পরে লিভিভ স্টেশনে পৌঁছই। সেখান থেকে ট্যাক্সি করে পোল্যান্ড সীমান্তের কাছে আসি। সেখানে ইউক্রেনের নাগরিকদের দ্রুত ছাড়া হয়। অথচ, ভারতীয় পড়ুয়াদের কাগজপত্রে সমস্যা আছে জানিয়ে অপেক্ষা করানো হচ্ছে। কয়েক জনের তো কাগজ ছিঁড়েও দিলেন ইউক্রেনের সেনারা।
টানা ছ’দিন হস্টেলের বম্ব শেল্টারে থাকার সময়ে যুদ্ধ কাকে বলে, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম। প্রতিদিন বোমার আওয়াজ শুনেছি। মনে হয়েছে আর বোধহয় বেঁচে থাকব না। এমনকি, পোল্যান্ড সীমান্তে যাওয়ার পথে যখন কিভে পৌঁছই, তখন ট্রেনের সামনে পর পর শেল পড়তে থাকে। বিস্ফোরণের শব্দে ট্রেন কেঁপে ওঠে।
এখন বাড়ি ফেরার আনন্দ যেমন আছে, তেমনই আছে মর্মান্তিক স্মৃতি। যে ভাবে চোখের সামনে ইউক্রেনকে ধ্বংস হতে দেখলাম, সেটা বড় বেদনার। নিজের দেশের পাশাপাশি ইউক্রেনকেও ভালবাসি। পড়তে আসার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় ও খারকিভ শহরটা প্রিয় হয়ে ওঠে। শহরটার শীত-গ্রীষ্ম— দুটো ঋতুর সৌন্দর্য স্বর্গের মতো। হস্টেল ও বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আমার দ্বিতীয় বাড়ি। মনে হচ্ছে, ইউক্রেনের নাগরিকদের মতো আমিও যেন ঘর হারালাম।
অনুলিখন: দেবাশিস দাশ
খারকিভ ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী