দেবাঞ্জন দেব ফাইল চিত্র
‘‘পুরসভার প্যাড চাই তো? হয়ে যাবে দাদা। যেমন চাইবেন, বানিয়ে দেব। তবে, খরচ কিন্তু একটু বেশি পড়বে।’’দেবাঞ্জন দেবের ঘটনার কথা শোনেননি? তার পরেও এত সহজে হয়ে যাবে?প্রশ্নটা কানে যেতেই মৃদু হাসলেন দোকানি। বললেন, ‘‘পুরসভার রাবার স্ট্যাম্প বা লেটারহেড তৈরির ক্ষেত্রে একটা চিঠি হলে ভাল হয়। কিন্তু কেউ তো আর যাচাই করতে আসে না। চিঠি নিয়েই বা কী করব! আপনি টাকা দিলেই ‘মাল’ রেডি!’’ ঘটনাস্থল: সূর্য সেন স্ট্রিটের একটি বই-খাতার দোকান। বইয়ের আড়ালে এখানে লেটারহেড থেকে রাবার স্ট্যাম্প— সব কিছুরই ব্যবস্থা হয়ে যায়। পুরসভার কোনও ‘অর্ডার’ হোক বা ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন, কড়ি ফেললে হাতে এসে যাবে সবই।
ভুয়ো প্রতিষেধক-কাণ্ডে ধৃত দেবাঞ্জন দেবের একাধিক ‘কীর্তি’ নিয়ে রাজ্য জুড়ে তোলপাড় চললেও জাল স্ট্যাম্প বা লেটারহেড ছাপানোর ব্যবসা এখনও চলছে রমরমিয়ে। দেবাঞ্জন যাদবপুরের একটি দোকান থেকে পুরসভার নাম লেখা নকল প্যাড ছাপাত বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। তবে শুধু যাদবপুর নয়, শহরের বিভিন্ন এলাকাতেই যে এই ব্যবসা কোনও রকম নিয়মের তোয়াক্কা না-করে বিনা বাধায় চলছে, তার প্রমাণ মিলল সোমবার দুপুরে, শিয়ালদহের সূর্য সেন স্ট্রিট ও বুদ্ধু ওস্তাগর লেনে। সেখানে দেখা গেল, রাবার স্ট্যাম্প ও মুদ্রণের সারি সারি দোকান। লোকজনের সংখ্যা অবশ্য হাতে গোনা। যে ক’জন আছেন, তাঁরা ব্যস্ত নিজেদের মধ্যে গল্প-গুজবে।
পুরসভার রাবার স্ট্যাম্প তৈরি করাতে চাই শুনেই এক দোকানি দেখতে চাইলেন, কেমন স্ট্যাম্প। সরকারি স্ট্যাম্প শুনে তাঁদের কয়েক জন জানালেন, একটা চিঠি থাকলে ভাল হত। কিন্তু চিঠি তো নেই। যা শুনে এক ব্যবসায়ীর উত্তর, ‘‘এখন যা চলছে, চিঠি ছাড়া এ সব করে শেষে পুলিশি ঝামেলায় পড়ব নাকি! কলকাতা পুরসভার প্যাডে একটা চিঠি করিয়ে আনুন বরং। বেআইনি কাজ আমরা করি না।’’
সাবধানি ওই বিক্রেতা চিঠি ছাড়া অর্ডার নেবেন না বলে জানালেও সকলে যে ততটা পরোয়া করেন না, তা বোঝা গেল এলাকায় একটু ঘুরেই। পরপর বেশ কয়েকটি দোকানের মালিক আশ্বাস দিলেন, চিঠির কোনও দরকার নেই। টাকা দিলেই অর্ডার তৈরি হয়ে যাবে। তাঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘এখন এই দেবাঞ্জনের জালিয়াতির ঘটনা সামনে এসেছে তো, তাই সকলে একটু খোঁজখবর নিচ্ছেন! চিঠিপত্র চাইছেন। দু’দিন যেতে দিন, সবই আবার আগের নিয়মে চলবে।’’ কিন্তু পুরসভা বা পুলিশি নজরদারি কি আদৌ দেখতে পান? উত্তর এল, ‘‘আপনার কি মনে হয় এ সবের খোঁজখবর আদৌ কেউ রাখে?’’
দেবাঞ্জন গ্রেফতার হতেই তার একের পর এক জালিয়াতির ঘটনা সামনে এসেছে। পুলিশি তল্লাশিতে কসবায় তার অফিস থেকে মিলেছে পুরসভার একাধিক জাল স্ট্যাম্প এবং ওয়ার্ক অর্ডার। তদন্তে উঠে এসেছে, যাদবপুর-সহ শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকেই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ওই সমস্ত নকল রাবার স্ট্যাম্প এবং পুরসভার বিভিন্ন নথি তৈরি করাত সে। দেবাঞ্জনের গ্রেফতারিও কিন্তু নিয়ম ভাঙার সেই অভ্যাসে বিশেষ পরিবর্তন আনতে পারেনি। হাতে গোনা দু’-এক জন চিঠি ছাড়া কাজ করবেন না বললেও তাঁদের সংখ্যাটা অতি নগণ্য।
কলকাতা পুরসভার প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য দেবাশিস কুমার এ বিষয়ে বললেন, ‘‘কারা, কোথায় জালিয়াতি করে প্যাড বা স্ট্যাম্প তৈরি করাচ্ছে, তা দেখাটা কিন্তু কলকাতা পুরসভার কাজ নয়। পুরসভার সমস্ত কাজ নিজস্ব ছাপাখানায় হয়। এই ধরনের জালিয়াতদের কাজ যাঁরা করবেন, দায়িত্ব তাঁদেরই নিতে হবে।’’
লালবাজারের যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার এক আধিকারিক বলেন, ‘‘এই ধরনের জিনিস এ ভাবে যে কেউ তৈরি করাতে পারেন। তা ব্যবহার করে অপরাধ সংঘটিত না-হলে কিছুই করার থাকে না। তবে এই ধরনের অপরাধ আটকাতে নজরদারি ও তল্লাশি চালানো হচ্ছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।’’