ভাগ্নির ইচ্ছেপূরণ, বিপ্লবীর মূর্তি বসছে ভবানী ভবনে

বৃদ্ধার কান্না দেখে অস্বস্তিতে পড়েছিলেন ওখানকার একাধিক পুলিশকর্মীও। লীলাবতীদেবী তাঁদের সামনেই বলেন, ‘‘আমার কাছে মামার আসল ছবি রয়েছে। তা নিয়ে একটা মূর্তি অন্তত বসানো হোক। শহরে তো কত মূর্তিই বসে।’’

Advertisement

অনুপ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৯ ০৩:০৩
Share:

ভবানী ভবনে এ বার বসতে চলেছে ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্যের (ডানদিকে) মূর্তি।

বছর ছয়েক আগে আলিপুরে ভবানী ভবনের পাশ দিয়ে ট্যাক্সিতে যাওয়ার সময়ে সঙ্গে থাকা জামাইয়ের কাছে হঠাৎই ওই ভবনে ঢোকার আব্দার করেন নবতিপর লীলাদেবী চক্রবর্তী। শাশুড়ির ইচ্ছায় তাঁকে ভবনের মূল গেটের সামনে নিয়ে যান জামাই ফাল্গুনী ঘোষাল। ঢোকার মুখে থাকা একটা ফলকের সামনে হাতে আঁকা একটি ছবি দেখেই কেঁদে ফেলেন লীলাবতীদেবী। হতবাক জামাইও। হাতে আঁকা ওই ছবিটি আসলে বিপ্লবী ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্যের। অত্যাচারী ইংরেজ শাসক জন অ্যান্ডারসনকে হত্যার যড়যন্ত্রে জড়িত থাকায় তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। ১৯৩৫ সালে, ঢাকার রাজশাহিতে। তাঁর নামেই ওই ভবন। সেই ভবানীপ্রসাদ সম্পর্কে লীলাবতীদেবীর মামা।

Advertisement

বৃদ্ধার কান্না দেখে অস্বস্তিতে পড়েছিলেন ওখানকার একাধিক পুলিশকর্মীও। লীলাবতীদেবী তাঁদের সামনেই বলেন, ‘‘আমার কাছে মামার আসল ছবি রয়েছে। তা নিয়ে একটা মূর্তি অন্তত বসানো হোক। শহরে তো কত মূর্তিই বসে।’’ ফাল্গুনী জানান, তাঁর শাশুড়ির থেকে বছর দশেকের বড় ছিলেন ভবানীপ্রসাদ। খুব কাছ থেকে মামাকে দেখেছিলেন বলে ওই ফলক দেখে আর আবেগ ধরে রাখতে পারেননি লীলাবতীদেবী। তার পর থেকে নবান্নে, তথ্য-সংস্কৃতি দফতরে শাশুড়ির আবেদন নিয়ে দরবার করেছিলেন ফাল্গুনী। কিন্তু, তেমন সাড়া মেলেনি।

ছ’বছর পর গত ৩ ফেব্রয়ারি ভবানী ভবনে ওই বিপ্লবীর ফাঁসির দিন স্মরণে এক অনুষ্ঠান হয়। সেখানে হাজির ছিলেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম। ফাল্গুনীর কথায়, ‘‘আমি প্রতি বছর ওই দিনটিতে যাই। এ বারও গিয়েছিলাম। মেয়রকে সামনে পেয়ে শাশুড়ির দীর্ঘকালের আবেদনের কথা জানাই। উনি যোগাযোগ করতে বলেছিলেন।’’ এর পরে কেটে গিয়েছে আরও কয়েক মাস। ফাল্গুনী জানান, গত ১ জুলাই ‘টক টু মেয়র’ অনুষ্ঠানে তিনি ফোন করে বিষয়টি স্মরণ করাতেই মেয়র বলেন, ‘‘আপনি শীঘ্রই পুর ভবনে এসে ভবানীপ্রসাদের ছবি দিয়ে যান। পুরসভা ওখানে ওঁর মূর্তি বসাবে।’’

Advertisement

শহরে কুইজের আসরে একটা প্রশ্ন প্রায়ই শোনা যায়: রাজ্য পুলিশের অন্যতম সদর দফতর আলিপুরের ভবানী ভবন। কেন এই নামকরণ?

তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর জানাচ্ছে, ১৯৩৪ সালে বাংলার রাজ্যপাল, অত্যাচারী ইংরেজ শাসক জন অ্যান্ডারসনকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন বাংলার বিপ্লবীরা। সেই দলে ছিলেন ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য, রবিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, উজ্জ্বলা মজুমদারেরা। তাঁদের কাছে খবর আসে, ৮ মে দার্জিলিংয়ে এক অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন রাজ্যপাল। যথাসময়ে ঘোড়দৌড়ের মাঠে সাহেবি পোশাক পরে হাজির হন বিপ্লবীরা। অনুষ্ঠান শেষ হতেই রাজ্যপালের কাছাকাছি পৌঁছে গুলি চালান ভবানী। কিন্তু তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় বেঁচে যান অ্যান্ডারসন। তাঁর রক্ষীর পরপর গুলিতে লুটিয়ে পড়েন ভবানী। ধরা পড়ে গেলে তাঁকে জেলে পাঠানো হয়। পরে মামলায় তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। ১৯৩৫ সালের ৩ ফেব্রয়ারি রাজশাহির কেন্দ্রীয় জেলে ফাঁসি হয় ভবানীপ্রসাদের। সরকারি তথ্য বলছে, ওই ইংরেজ

শাসকের নামে আলিপুরে অ্যান্ডারসন হাউস গড়ে তুলেছিল ব্রিটিশেরা। স্বাধীনতার পরে ওই বাড়ির নাম বদল নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি ওঠে। সে কথা মাথায় রেখেই ১৯৬৯ সালে অ্যান্ডারসন হাউসের নাম বদলে হয় ভবানী ভবন।

কিন্তু, তখন থেকেই কোনও মূর্তি বসানো হয়নি ওই বিপ্লবীর। এ বার তা বসানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে। পুরসভার এক আধিকারিক জানান, মেয়রের নির্দেশে ইতিমধ্যেই পার্ক ও উদ্যান দফতরকে ভবানীপ্রসাদের ছবি-সহ তথ্য পাঠানো হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে বিপ্লবীর আবক্ষ মূর্তি দ্রুত তৈরি করতে। তা হয়ে গেলেই মূর্তি স্থাপনের দিন ঘোষণা করা হবে।

পুর প্রশাসনের এই উদ্যোগে খুশি প্রবীণা লীলাবতীদেবী এবং তাঁর মেয়ে তনুজা ঘোষাল। জামাই ফাল্গুনী বললেন, ‘‘শাশুড়িকে কথা দিয়েছি, মূর্তি স্থাপনের দিন নিয়ে যাব। সেই দিনের অপেক্ষায় রয়েছি। কোনও অনুদান নয়, আমরা চেয়েছিলাম যোগ্য সম্মান পান ভবানীপ্রসাদ। এ বার হয়তো তা পূরণ হতে চলেছে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement