ফুটপাতের ঘরকন্না। বিডন স্ট্রিটে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
ঢাকের আওয়াজ শুনে আনন্দ নয়, ফিরে ফিরে আসে আতঙ্ক। কয়েক দিনের জন্য খোলা আকাশের নীচের দখল ছেড়ে আবার ভবঘুরে হওয়ার পালা। পাঁচটা দিন এ ভাবেই প্রতি বছর কাটে ওঁদের। তাই মণ্ডপের বাঁশ বাঁধায় গতি দেখলেই মনে মেঘ জমে টালা থেকে টালিগঞ্জের ফুটপাতবাসীদের। জাঁকজমকের মণ্ডপ ঘিরে যেন প্রদীপের নীচেই অন্ধকার।
প্লাস্টিকের ব্যাগে সংসারের টুকিটাকি ঢুকিয়ে দিনকয়েকের জন্য ফের উদ্বাস্তু হতে হয়। গড়িয়াহাট, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের মতো রাস্তার ফুটপাত ধরে যখন প্রতিমা দর্শনের
সর্পিল লাইন এগোতে থাকে, তখন কারও কি মনে হয়, কোথায় গেলেন এই তল্লাটের ফুটপাতবাসীরা? আসলে তাঁদের বেশির ভাগই তখন ময়লা কাপড়ে জিনিস বেঁধে ঘোরাফেরা করেন আশপাশের কম ভিড়ের রাস্তায়। কেউ মাথা গোঁজেন নিজেদের কর্মস্থলে। অপেক্ষাকৃত সৌভাগ্যবানেরা পাড়ি দেন দূরের জেলায়, যেখানে নিজেদের ঠিকানায় থাকেন অপেক্ষার মানুষ।
এ শহরে ঝাঁ-চকচকে, উঁচু ইমারতের প্রতিযোগিতা বাড়লেও ফুটপাতবাসীর সংখ্যা যে কমেনি, এমনটা সময়ে সময়ে দাবি করে থাকে বিভিন্ন মহল। বিধান সরণি, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোড, লেনিন সরণি, গড়িয়াহাটে দেখা মেলে ফুটপাতের সংসারের। প্লাস্টিকের নীচে চলে রান্না, খাওয়া, বিশ্রাম, ঘুম। ভোর হতেই কেউ পরিচারিকার কাজে, কেউ বা অন্য কাজে বেরিয়ে পড়েন। কাজ শেষে সেই ‘কেয়ার অব ফুটপাত’। শীত, গ্রীষ্ম বা বর্ষায় সেটাই তাঁদের ‘স্থায়ী’ ঠিকানা। কখনও কখনও ঋতু বিশেষে অবশ্য বদলে যায় অস্থায়ী ছাউনির ঢাল।
পুজোর ক’দিন মণ্ডপে ঘোরা দর্শনার্থীদের ভিড়, পুজোকর্তাদের খোঁচা, পুলিশের শাসানি তাড়িয়ে বেড়ায় সারা বছরের আস্তানা থেকে। গড়িয়াহাট সংলগ্ন রাস্তার ফুটপাতের বাসিন্দা পূর্ণিমা বড়াল বললেন, ‘‘যে বাড়িতে কাজ করতাম, গত পুজোর ক’দিন ছেলেটাকে নিয়ে সেখানে থেকেছিলাম। ওই কাজটা নেই। তাই এ বছর কী করব, জানি না!’’ বিধান সরণির ফুটপাতে থাকেন বছর ষাটের ছায়া মাঝি। জ্ঞান হওয়া ইস্তক এখানেই রয়েছেন মহিলা। তাঁর কথায়, ‘‘পুজোর ক’দিন তো রাস্তায় মানুষের ভিড় থাকে। পুলিশের নানা রকম নিষেধও থাকে। তাই বাধ্য হয়ে ক’দিনের জন্য অন্য দিকে যেতে হয়। পুজো মিটলে ফিরে আসি।’’
এই ফিরে আসা যে সব সময়ে মসৃণ হয়, তেমনটা নয়। দখলদারির ফুটপাত মাঝেমধ্যেই বেদখল হয়ে যায়। আশপাশের পুজো উদ্যোক্তাদের একাংশের মদতে ফুটপাতে বসে পড়ে অস্থায়ী দোকান। আবার পুজোর ক’দিন বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের থেকে সাহায্য পাওয়ার আশায় দূর থেকে অনেকে হাজির হয়ে ফুটপাতেই থেকে যান। এমনই আশঙ্কার কথা শোনালেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডের ফুটপাতের বাসিন্দা রুমি মাঝি। রুমি বলেন, ‘‘গত বছর পুজোর শেষে ফিরে দেখি, জায়গা দখল হয়ে গিয়েছে। সব সরে যাওয়ার জন্য দু’দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে।’’ ঢাকের আওয়াজ তাই যন্ত্রণার গল্প মনে করায় লেনিন সরণির রিমা, স্মরজিৎ কিংবা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডের তারক, নাসিরদের।
বাঁশের কাঠামো যখন সেজে উঠেছে রঙিন বিজ্ঞাপনে, তখন ফুটপাতের সংসার ভরে উঠছে বিবর্ণ হওয়া রঙিন প্লাস্টিকের ব্যাগে। উৎসব মানেই এ বার ওঁদের উদ্বাস্তু হওয়ার পালা।