ভো কাট্টা: কে কার ঘুড়ি আগে কাটবে, চলছে তার লড়াই। রবিবার, কুমোরটুলি পার্কে। ছবি: সুমন বল্লভ।
উৎসব আসে, উৎসব যায়। কিন্তু শহরের রাস্তায় চিনা মাঞ্জার (সিন্থেটিক মাঞ্জা দেওয়া নাইলনের সুতো) বিপদ কাটে না। চোখে, মুখে, নাকে, গলায় চেপে বসা এমন কাচের গুঁড়ো মিশ্রিত সুতোর বিপদ কাটাতে রাজধানী দিল্লিতে পাঁচ বছরের জেল এবং এক লক্ষ টাকা জরিমানার কড়াকড়ি করা হলেও এই শহরে কিছুই হয় না। এমন সুতো বিক্রির জন্য মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনীতে ব্যবসায়ীর বাড়ি সরকার বুলডোজ়ার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিলেও এই রাজ্যে তেমন নজির দেখা যায় না। উল্টে আরও একটি বিশ্বকর্মা পুজোর মুখে আতঙ্ক বাড়ে আকাশে ঘুড়ির ঝাঁক এবং গলিঘুঁজিতে দেদার এমন সুতো বিক্রির রমরমা দেখে।
পুলিশ সূত্রের খবর, চলতি বছরে শহরে মাঞ্জা সুতোর জেরে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ছ’টি। আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে অন্তত ১৭টি ক্ষেত্রে। কারও গলার নলি কেটে গিয়েছে, কারও চোখ দু’টুকরো হয়ে গিয়েছে। হুড খোলা গাড়িতে পরিবারের সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়ে শিশুর মৃত্যুরও ঘটনা ঘটেছে। আরও জানা যাচ্ছে, স্বাধীনতা দিবস এবং পয়লা বৈশাখের সময়ে সব চেয়ে বেশি এমন দুর্ঘটনা পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত হয়েছে। শুধু উড়ালপুলে নয়, সুতোর জেরে বিপদ ঘটেছে সাধারণ রাস্তাতেও। বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়েও রক্ষা পাওয়া যায়নি! পরিবেশকর্মীদের বক্তব্য, পুলিশি হিসাব থাকে শুধু নথিভুক্ত ঘটনায়। কিন্তু, বিপদ আরও গভীরে। বহু ক্ষেত্রেই বিষয় থানা পর্যন্ত গড়ায় না। বিশেষ করে পায়রা এবং পাখির দল এমন সুতোর জেরে ভুগছে মানুষের চেয়েও বেশি। গলা বা পাখনা কেটে মৃত্যু ঘটলেও বহু ক্ষেত্রেই পশুপ্রেমীদের কিছু করার থাকছে না।
একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটায় ২০১৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতীয় পরিবেশ আদালত দেশ জুড়ে চিনা মাঞ্জা নিষিদ্ধ করেছিল। জাতীয় পরিবেশ আদালতের চেয়ারম্যান, বিচারপতি স্বতন্ত্র কুমারের ডিভিশন বেঞ্চ প্রতিটি রাজ্যের মুখ্যসচিবকে ওই নির্দেশ অবিলম্বে কার্যকর করতে বলেছিল। নির্দেশে বলা হয়েছিল, দেশে ওই মাঞ্জা সুতো তৈরি, মজুত ও কেনাবেচা বন্ধ করতে হবে। সমস্ত জেলার জেলাশাসক ও জেলা পুলিশের প্রধানকে ওই নির্দেশের প্রতিলিপি পাঠিয়ে চিনা মাঞ্জায় ঘুড়ি ওড়ানো নিষিদ্ধ করতে বলা হয়। এই সুতো বা মাঞ্জার উপকরণ বিদেশ থেকে আমদানি করার উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। বলা হয়েছিল, নির্দেশিকা অমান্য করে কেউ চিনা মাঞ্জা দেওয়া সুতো ব্যবহার করলে ১৯৮৬ সালের পরিবেশ রক্ষা আইন এবং ১৯৭২ সালের বন্যপ্রাণ সুরক্ষা আইনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। সুপ্রিম কোর্টও সেই নির্দেশই বহাল রাখে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও চিনা মাঞ্জার বিক্রি বন্ধ হয়নি বলে অভিযোগ। শহর এবং শহরতলি জুড়ে এ বছরও রমরমা এমন সুতোর। সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার, ক্রিক রো, বাঘা যতীন-সহ একাধিক এলাকার ঘুড়ি বাজারে রীতিমতো ১০০ টাকা মিটারে বিক্রি হচ্ছে এমন সুতো। লাটাই সঙ্গে নিয়ে গেলেই বৈদ্যুতিক যন্ত্রের মাধ্যমে সুতো ভরে দেওয়া হচ্ছে। ক্রেতাদের অকপটে বলা হচ্ছে, যে সুতোয় যত বেশি কাচের মিশ্রণ, সেই সুতো তত ধারালো এবং অন্যের ঘুড়ি কাটতে তত কার্যকর। বড়বাজারে আবার এমন সুতোর দোকানে প্লাস্টিক এবং রাবারের জিনিস বসিয়ে সুতো দিয়ে তা এ ফোঁড়-ও ফোঁড় করে দেখানো হচ্ছে কার্যকারিতা। দক্ষিণ এবং উত্তর ২৪ পরগনার বহু বাজার থেকেও শহরে এমন সুতো ঢুকছে বলে দাবি। কলেজ স্ট্রিটের একটি ঘুড়ির দোকানের মালিক বললেন, "আমরা না বিক্রি করলেও লোক হাতে পেয়ে যাবে। দমদম, বারাসত, বারুইপুর, সোনারপুরের রাস্তার মোড়ে মোড়ে এমন সুতোর দোকান।"
কিন্তু পুলিশ কিছু বলে না? লালবাজারের এক কর্তা জানালেন, চিনা মাঞ্জা বিক্রি বন্ধ করতে ঘুড়ি বাজারগুলিতে নজরদারি চালানো হচ্ছে। ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য বিখ্যাত বা অতীতে চিনা মাঞ্জায় আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, এমন জায়গায় মাইকে প্রচারও চালানো হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের বোঝানো হচ্ছে, বিধি-ভঙ্গে শাস্তি কী হতে পারে। পুলিশ সূত্রের খবর, চিনা মাঞ্জা বিক্রি করলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৮৮ ধারায় ব্যবস্থা নেওয়া যায়। জিনিস বাজেয়াপ্ত করার পাশাপাশি তাঁকে গ্রেফতারও করা হতে পারে। একই রকম প্রচার মানুষকে সচেতন করার জন্যও চলছে বলে দাবি পুলিশের। কিন্তু কাজ হচ্ছে কি? বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে।