খেলাধুলোর বিভিন্ন ক্ষেত্রেই পরিকাঠামোর অভাব ও সুরক্ষায় গাফিলতির অভিযোগ ওঠে বার বার। তার পরেও কি শিক্ষা নেওয়া হবে না?
Death

এমন গাফিলতিতে মামলা হোক, বলছেন পুত্রহারা বাবা

দেবব্রত। এক মাসের মাথায় ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেই এক দিন সব শেষ। পরিবারের কাছে ফোন গিয়েছিল, বজ্রাঘাতে জখম হয়ে ওই তরুণ হাসপাতালে ভর্তি।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০২২ ০৭:১৯
Share:

‘‘আর কতগুলো মৃত্যুর পরে গাফিলতি বন্ধ হবে? নিরাপত্তার পর্যাপ্ত বন্দোবস্ত ছাড়া যে কোনও খেলাই যে মৃত্যু-ফাঁদ হয়ে উঠতে পারে, সেই বোধোদয়ই বা হবে কবে?’’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন শ্রীরামপুরের দীপক পাল। কয়েক মিনিট চুপ থেকে বুজে আসা গলায় রবীন্দ্র সরোবরের সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা সম্পর্কে প্রৌঢ় বললেন, ‘‘যাঁর যায়, তাঁর যায়। বাকিরা কয়েক দিন সহানুভূতি দেখান। তাতে পরিস্থিতি পাল্টায় না। যেমন, আমার ছেলের মৃত্যুর পরেও কিছু পাল্টায়নি।’’

Advertisement

২০১৮ সালের ১০ জুন দক্ষিণ কলকাতার একটি ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ চলাকালীন বজ্রাঘাতে মৃত্যু হয়েছিল দেবব্রত পাল নামে এক তরুণ ক্রিকেটারের। দীপকবাবু দেবব্রতের বাবা। প্রশ্ন ওঠে, ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকা সত্ত্বেও কেন প্রশিক্ষণ হচ্ছিল? অভিযোগ উঠেছিল, দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া তো দূর, ওই কেন্দ্রে প্রাথমিক কোনও শুশ্রূষাও মেলেনি। ছিল না অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবাও।

রবীন্দ্র সরোবরে রোয়িং করতে নেমে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে দুই কিশোরের ডুবে মৃত্যুর ঘটনাতেও একাধিক অভিযোগ উঠেছে। কালবৈশাখীর পূর্বাভাস সত্ত্বেও কেন রোয়িং করতে দেওয়া হল, সেই প্রশ্ন রয়েছে। তা ছাড়া, নিয়ম মেনে উদ্ধারকাজের জন্য কোনও ‘ফলো বোট’ কেন রাখা হয়নি এবং উদ্ধারকাজে কেন দেরিতে ডুবুরি নামানো হয়, উঠেছে এমন প্রশ্নও। সরোবরের পাড়ে অন্তত নজরদারির ব্যবস্থা ছিল না কেন, তারও জবাব মেলেনি। দীপকবাবু বললেন, ‘‘ওই দুটো পরিবারের উপর দিয়ে কী যাচ্ছে, বুঝতে পারছি। যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, এমন গাফিলতির জন্য মামলা হওয়া উচিত তাঁদের বিরুদ্ধে।’’

Advertisement

দেবব্রতের বাড়ি শ্রীরামপুরের ভট্টাচার্য গার্ডেন রোডে। বছর একুশের ওই তরুণের দিদি লাবণি ডাক বিভাগে চাকরি করেন। দীপকবাবু প্রতিরক্ষা বাহিনীতে ছিলেন। অবসর নেওয়ার পরে ছেলেই ছিল ধ্যান-জ্ঞান। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী চন্দনা পালও। দীপকবাবু বলেন, ‘‘ও কখনও আমার কথার অবাধ্য হত না। তখন সবে বি-কম পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মেয়ের তখন আলিপুরদুয়ারে পোস্টিং। আমরা সকলেই মেয়ের কাছে গিয়েছি। এক দিন ছেলে বলল, ক্রিকেটের প্রশিক্ষণ নিতে চায়। বন্ধুদের সঙ্গে আগেও নানা জায়গায় ক্রিকেট খেলে বেড়াত। সেটাই ভাল করে খেলতে চায়। বলল, হাতে তিন মাস সময় রয়েছে। সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবে আর ক্রিকেট শিখবে। রাজি হয়ে গেলাম।’’

শুরু হল শ্রীরামপুর থেকে কলকাতায় রোজ যাতায়াত। ওই ক্রিকেট ক্যাম্পের খোঁজ নিজেই জোগাড় করেছিলেন দেবব্রত। এক মাসের মাথায় ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেই এক দিন সব শেষ। পরিবারের কাছে ফোন গিয়েছিল, বজ্রাঘাতে জখম হয়ে ওই তরুণ হাসপাতালে ভর্তি। দ্রুত কলকাতায় ছুটে এসেছিলেন পরিজনেরা। কিন্তু ছেলের সঙ্গে আর কথা বলার সুযোগ হয়নি। ফিরতে হয়েছিল তাঁর নিথর দেহ নিয়ে।

চার বছরে আলিপুরদুয়ার থেকে কলকাতায় পোস্টিং পেয়ে চলে এসেছেন দেবব্রতের দিদি। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন দীপকবাবুরা। শ্রীরামপুরেই তাঁর শ্বশুরবাড়ি। চাকরি, বাড়ি সামলে প্রতিদিনই বাবা-মায়ের কাছে আসেন মেয়ে। তাতেও যেন ছেলের অভাব পূরণ হয় না পাল দম্পতির। চন্দনাদেবী বলেন, ‘‘ছেলে ক্রিকেট শিখবে বলে রাতারাতি জুতো, ব্যাট— সব কিনে দিয়েছিলেন ওর বাবা। অনেক বার ভেবেছি, ওগুলো কাউকে দিয়ে দেব। কিন্তু পারিনি। এখনও ওগুলোকে আঁকড়েই বেঁচে আছি আমরা।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement