(বাঁ দিক থেকে ডানদিকে) মদনমোহন ভুঁইয়া, নীলেশ ভুঁইয়া ও দেবমাল্য দেবনাথ।
পাহাড়ে যেতে ভালবাসতেন ওঁরা। ট্রেকিংয়ের নেশা ছিল সকলেরই। ঠিকানা আলাদা হলেও সকলেরই ট্রেকিংয়ের গন্তব্য ছিল এক। এ বারও সকলে একসঙ্গে রওনা দিলেন ঠিকই। কিন্তু দুর্ঘটনা তাঁদের আর বাড়ি ফিরতে দিল না। গাড়ি খাদে পড়ে যাওয়ায় মৃত্যু হল স্বামী, স্ত্রী ও সন্তানের। বাঁচলেন না ট্রেকিংয়ের সঙ্গীরাও।
উত্তরাখণ্ডের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন মদনমোহন ভুঁইয়া, স্ত্রী ঝুমুর ভুঁইয়া ও ছেলে নীলেশ ভুঁইয়া। সোমবার তাঁরা বাড়ি থেকে বেরোন। মদনমোহন ও ঝুমুর পেশায় লাইব্রেরিয়ান। নীলেশ উত্তরপ্রদেশে পাইলটের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। নরেন্দ্রপুর থানা এলাকার শ্রীনগরের বাসিন্দা তাঁরা। আকস্মিক এই ঘটনায় গোটা পাড়া স্তম্ভিত।
তাঁদের বাড়ির কাছেই থাকেন মদনমোহনের ভাইপো নীলাদ্রিশেখর ভুঁইয়া। তিনি জানান, তাঁদের আদি বাড়ি পাথরপ্রতিমায়। সেখান থেকেই মদনমোহনের দাদা, অর্থাৎ নীলাদ্রির বাবা তাঁকে দুর্ঘটনার খবর দেন। এ দিন ওই পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, শোকাহত প্রতিবেশীরা কথা বলার অবস্থায় নেই। বাড়ির সামনে ভিড়। তাঁরা জানান, মদনমোহন নিউ আলিপুরের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থার লাইব্রেরিয়ান ছিলেন। আর ঝুমুর ছিলেন নিউ ব্যারাকপুরের একটি কলেজের লাইব্রেরিয়ান।
ওই পরিবারের ঘনিষ্ঠ দেবাশিস ঘোষের কথায়, ‘‘গত অক্টোবরে মদনমোহনবাবু সপরিবার কেদারনাথে ট্রেক করতে গিয়েছিলেন। গত ফেব্রুয়ারিতেও স্বামী-স্ত্রী ও ছেলে পহেলগামের আরু ভ্যালিতে ট্রেক করেন। এ বারেও তাঁরা ট্রেক করতে যান। আমারও যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু যাওয়া হয়নি।’’ এই বছরেই মদনমোহনের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অফিস চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়।
তিন জনের দেহ কলকাতায় ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন রাজপুর-সোনারপুর পুরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পিন্টু দেবনাথ। তিনি বলেন, ‘‘ওঁদের দেহ দ্রুত কলকাতায় ফিরিয়ে আনার জন্য সব ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’’ ওই পরিবার সূত্রের খবর, ট্রেকিংকে কেন্দ্র করে মদনমোহনদের একটি বড় দল ছিল। সেই দলেরই সদস্য ছিলেন ব্যারাকপুরের দেবমাল্য দেবনাথ ও প্রদীপ দাস। ওই দুর্ঘটনায় তাঁদেরও মৃত্যু হয়েছে। তাঁরা ২৩ মে রওনা দিয়েছিলেন। গন্তব্য ছিল,উত্তরাখণ্ডের গোমুখ। একই গাড়িতে ছিলেন সকলে। টিহরীতে ওই দুর্ঘটনা ঘটে।
দেবমাল্য থাকতেন ব্যারাকপুরের শ্যামশ্রীপল্লিতে। ইছাপুর রাইফেল কারখানায় কর্মরত ছিলেন। এ দিন সন্ধ্যায় পরিবার তাঁর মৃত্যুর খবর পায়। ভাইয়ের আকস্মিক মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না দাদা নির্মাল্য দেবনাথ। তিনি বলেন, ‘‘আগেও তো ভাই বহু বার ট্রেক করেছে। এ বার কী করে দুর্ঘটনা ঘটল, বুঝতে পারছি না।’’ স্বামীর মৃত্যুর খবর খুব কষ্ট করে সাত বছরের মেয়ে ও শাশুড়ির কাছ থেকে গোপন রেখেছেন দেবমাল্যের স্ত্রী পায়েল। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘‘আমাদের সাত বছরের মেয়ে রয়েছে। এখনও পর্যন্ত মেয়ে আর শাশুড়িকে কিছু জানাতে পারিনি। এমন খবর কী ভাবে জানাব!’’
দেবমাল্যদের ভাড়াটে, ব্যারাকপুর পুরসভার ছ’নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কেকা মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমরা হতবাক। চেষ্টা করছি, ঘটনাস্থলের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করার। বাড়ির লোকেরাও বিশ্বাস করতে পারছেন না।”
নৈহাটির শ্যাম রোডের বাসিন্দা প্রদীপ দাস পেশায় ছিলেন রেলের সেকশন ইঞ্জিনিয়ার। তিনিও ছিলেন ওই দলে। পরিবারের ছেলের মৃত্যুতে আত্মীয়েরা শোকস্তব্ধ। রাতে প্রদীপের বাড়ি পৌঁছন নৈহাটির বিধায়ক পার্থ ভৌমিক। তিনি জানান, আপাতত মৃতদের দেহ দ্রুত কলকাতায় ফেরানোর চেষ্টা হচ্ছে। ওই পরিবারকে সব ধরনের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।