রাত ২টোর সময়ে যখন ওর সঙ্গে শেষ বার কথা হয়, তখন ও ধ্বংসস্তূপের নীচে! ও মানে— ইমরান, মহম্মদ ইমরান আমার ১০ বছরের বন্ধু। এলাকায় সমাজকর্মী হিসেবেও পরিচিত। শুনেছি, রোজা শেষের পর ইমরান ওই নির্মীয়মাণ বাড়িতে গিয়েছিল ধূমপান করতে। তখনই বাড়িটা ভেঙে পড়ে। চাপা পড়ে যায় ও। খবর পেয়েই ওই ধ্বংসস্তূপের সামনে পৌঁছই। তখন থেকে অপেক্ষাই!
বার বার কানে বাজছে ইমরানের কাতর আর্তি, ‘‘আমাকে বাঁচা। দম আটকে আসছে। আমাকে বার করার ব্যবস্থা কর। আমি মারা যাব।’’
গোড়া থেকে বলি। প্রতিদিনের মতো রবিবার রাতেও আমরা রোজা ভাঙার পরে খাওয়াদাওয়া করছিলাম। পরবর্তী নমাজের জন্য রাত জাগতে হচ্ছে। সাড়ে ১২টা নাগাদ ওই বাড়ি ধসে যাওয়ার খবর পাই। ওই এলাকায় আমার অনেক বন্ধুবান্ধবের বাড়ি। তাই তড়িঘড়ি ছুটে যাই। দেখি, লোকজন দুর্ঘটনাস্থলের দিকে পাগলের মতো ছুটছে। আমিও এগিয়ে যাই। চারদিকে অন্ধকার, ধুলোয় চারপাশ ঢেকে গিয়েছে। আর্তনাদ, চিৎকার—সব মিলিয়ে ভয়ের পরিবেশ। সেখানেই শুনি, ইমরান চাপা পড়েছে। বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। কয়েক ঘণ্টা আগেই তো ফোনে কথা হল! পায়ের তলার মাটি যেন সরে-সরে যাচ্ছিল।
কিছু ক্ষণ পরে নিজেকে সামলে নিলাম। স্থানীয়দের অনেকেই তখন উদ্ধারকাজে নেমে পড়েছেন। আমিও হাতে-হাত লাগিয়ে কাজে নামলাম। স্থানীয়েরাই বার করে আনলেন এক বৃদ্ধা এবং একটি শিশুকে। আমি এ দিক-সে দিক দেখে ধ্বংসস্তূপের সামনে গিয়ে ‘ইমরান, ইমরান’ বলে চেঁচাতে শুরু করি। কোনও উত্তর অবশ্য কানে আসছিল না, শুধু ভেসে আসছিল গোঙানি। ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছিল সেই গোঙানি। হঠাৎ মনে হল, এক বার ইমরানকে ফোন করে দেখি তো!
ফোন করতেই ও ফোন ধরেছিল। এক বার নয়, দু’-তিন বার ফোনে কথা হয়েছিল। বুঝতে পারছিলাম, প্রবল কষ্টের মধ্যে আছে ও। শেষ বার কথা হয়েছিল রাত ২টো নাগাদ। তখন ইমরানের বাঁচার আর্তি। তার পর আর সাড়া পাইনি। ভাবলাম, মোবাইলের ব্যাটারির চার্জ বোধ হয় ফুরিয়ে গিয়েছে। তাই শুধু অপেক্ষা করে গিয়েছি। এক অদ্ভুত অপেক্ষা। মনকে বুঝিয়ে গিয়েছি, বন্ধু ঠিক বেরিয়ে আসবে। অপেক্ষা শেষে হল যখন ইমরান বার হল, বার করা হল তার নিথর দেহ। শুধু তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না।