ভেঙে পড়া সেতু থেকে মিনিবাস ক্রেন দিয়ে তোলা হচ্ছে।—নিজস্ব চিত্র।
এ যেন শাঁখের করাত। যে দিকেই টানা হোক না কেন, তাতেই কাটা যাচ্ছে পূর্ত দফতরের নাক!
কী ভাবে ভেঙে পড়ল মাঝেরহাট সেতুর ওই অংশ? তা জানার চেষ্টা করতেই আমরা বুধবার সকালে নির্মাণ ও পরিবহণ বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার অনির্বাণ পালকে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছেছিলাম ঘটনাস্থলে। ঘণ্টাখানেকেরও বেশি সময় ধরে গোটাটা খতিয়ে দেখে যা উঠে এল, তা শহরবাসীর কাছে মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। প্রাথমিক ভাবে যে সব কারণ উঠে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, সমস্ত গাফিলতিটাই পূর্ত দফতরের। তারা যদিও সেই দায় নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
প্রায় ৫০ বছর আগে তৈরি হয়েছিল মাঝেরহাটের ওই সেতু। মঙ্গলবার সেতুর দু’টি স্তম্ভের মধ্যবর্তী প্রায় ৪৫ মিটার একটা অংশ ভেঙে পড়ে। ওই অংশটি গার্ডারের সাহায্যে যে দু’টি স্তম্ভের উপর লাগানো ছিল, সে দু’টিতে কোনও ফাটল বা বিচ্যুতি নেই। মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গার্ডার সরে যাওয়ার ফলেই ওই বিপর্যয় ঘটেছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু, কেন গার্ডার সরে গেল? ক্ষতিগ্রস্তই বা হল কী করে, তা নিয়ে একাধিক মত উঠে এসেছে।
লন্ডভন্ড মাঝেরহাট সেতু। ছবি: রয়টার্স।
প্রথমত, রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম-সহ অনেকেই এ জন্য জোকা-বিবাদী বাগ মেট্রো রেলের নির্মাণকাজের কম্পনকে দায়ী করেছেন। তাঁদের মতে, মেট্রো প্রকল্পের জন্য যখন স্তম্ভ তৈরি করা হচ্ছিল, সেই কম্পনের জেরেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাঝেরহাট সেতু।
কিন্তু, মেট্রোর নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত সংস্থা রেল বিকাশ নিগম লিমিটেডের দাবি, তাদের নির্মাণকাজের সঙ্গে সেতু ভেঙে পড়ার কোনও সম্পর্ক নেই। ওই সেতুর গার্ডার আগে থেকেই জীর্ণ ছিল। তাই সেতু ভেঙেছে।
সে ক্ষেত্রে পাল্টা মত, ওই কম্পনের জেরেই গার্ডার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সরে গিয়েছে। আর তার ফলেই এই ভেঙে পড়া। আর এখানেই পূর্ত দফতরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
যদি মেট্রোর নির্মাণকাজের কম্পনের জেরেই গার্ডার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সরে গিয়ে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটে, তা হলে বিষয়টি আগে থেকে লক্ষ্য করেনি কেন পূর্ত দফতর? মেট্রোর স্তম্ভ তো এক বছর আগে তৈরি হয়েছে। সেই সময়টাই যদি গার্ডার সরে যাওয়ার প্রাথমিক পর্যায় হয়ে থাকে, তা হলে এই এক বছর ধরে পূর্ত দফতর কী করছিল? তখনই যদি বিষয়টি নজরে পড়ত, তা হলে আগাম সতর্কতা নেওয়া যেত বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
অনির্বাণ পাল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নির্মাণ ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চলে যান আমেরিকার ওহায়োতে। সেখানকার টলেডো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএস করে দীর্ঘ দিন চাকরি করেছেন মার্কিন মুলুকে। বুধবার ভেঙে পড়া সেতুর বিভিন্ন অংশ অনেক ক্ষণ ধরে পরীক্ষানিরীক্ষার পর তিনি বলেন, ‘‘মেট্রো প্রকল্পের কম্পনের জন্য সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হলে মূল স্তম্ভগুলিতে তার ছাপ থাকত। অথচ কোনও স্তম্ভেই কোনও ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন নেই। গোটাটাই গার্ডারের ব্যর্থতা। গার্ডার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সরে গিয়েই এই বিপর্যয় হয়েছে। কেন গার্ডারের এই অবস্থা হল, তা আরও তদন্ত করে দেখতে হবে।’’
তাঁর মতে, যে কোনও সেতু তৈরির একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর থেকেই তার স্বাস্থ্যপরীক্ষার প্রয়োজন হয়। সেতুটি যানবাহনের ভার বহনে কতটা সক্ষম, সেতুর কাঠামোতে কোনও ক্লান্তি জমা হয়েছে কি না, যে মালমশলা দিয়ে সেতু তৈরি হয়েছিল এত বছর পর সেগুলো কী অবস্থায় আছে, সবটাই ওই পরীক্ষাতেই ধরা পড়ে।
মেট্রো প্রকল্পের কম্পনের কারণে যদি গার্ডার সরে গিয়ে থাকে, তা হলে সেতুর স্বাস্থ্যপরীক্ষাতেই তা ধরা পড়ত বলে অনির্বাণবাবুর মত। তিনি বলেন, ‘‘দায়িত্বশীল সংস্থা সেতুর স্বাস্থ্যপরীক্ষার কাজটা নিয়মিত করে উঠতে পারেনি। তার ফলে, গার্ডার সরে গিয়ে সেতু ভেঙে পড়াটা রোখা গেল না।’’
ঘটনাস্থলের ভিডিয়ো দেখুন...
দ্বিতীয়ত, মাঝেরহাট সেতুর রক্ষাণাবেক্ষণের কাজটি ঠিকঠাক হয়নি বলেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে একটা অংশের মত। ছ’মাস আগেই পূর্ত দফতর এই সেতু পরীক্ষা করে ‘ফিট সার্টিফিকেট’ দিয়েছিল। কিন্তু, কীসের ভিত্তিতে? প্রশ্নটা উঠছে। এ দিন সেতুটির ভেঙে পড়া কংক্রিটের অংশ পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, তার অনেক দূর পর্যন্ত জল ঢুকে রয়েছে। এবং সেই জল যে এক দিনে ঢোকেনি, সেটাও স্পষ্ট।
কিন্তু, কী ভাবে এই জল ঢুকল? বিশেষজ্ঞদের মতে, এক দিনে কংক্রিটের প্লেটে এ ভাবে জল ঢোকেনি। সেতুর ওই অংশে কোনও ভাবে কংক্রিটের ভিতর থেকে লোহার খাঁচা উন্মুক্ত হয়ে পড়েছিল। সেখান থেকেই দিনের পর দিন চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল ঢুকেছে এবং সেতুকে দুর্বল করে দিয়েছে। তাকে ধীরে ধীরে করে তুলেছে ভঙ্গুর। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত, সেতুর স্বাস্থ্যপরীক্ষা নিয়মিত ভাবে হলে এই উন্মুক্ত অংশ নজরে পড়ত এবং তা মেরামতির ব্যবস্থা করা হত।
মঙ্গলবার ভেঙে পড়ার পরের দৃশ্য।—নিজস্ব চিত্র।
ভেঙে পড়া সেতুর চার পাশ ঘুরে এ দিন দেখা গিয়েছে, প্রচুর ঝোপঝাড়, এমনকি একটু বড় বড় গাছও। সেতুর ভিতরে ওই সব গাছের শিকড় বহু দূর পর্যন্ত চারিয়েছে বলেই বিশেষ়জ্ঞদের ধারণা। সেতুর কংক্রিটের প্লেটে ঢুকে পড়া ওই সব শিকড় তাকে আরও দুর্বল করেছে। সেতুতে ফাটল ধরিয়েছে ভিতরে ভিতরে। তার ফলেই গার্ডার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু, এই সব গাছপালা পরিষ্কার করার দায়িত্ব কাদের? বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, অবশ্যই পূর্ত দফতরের। ফলে এ ক্ষেত্রেও অভিযোগের আঙুল সরাসরিই পূর্ত দফতরের দিকে।
আরও পড়ুন
মেট্রোর কাজেই ব্রিজের ক্ষতি, অনড় পুরমন্ত্রী, তদন্তে রাইটস-ও
তৃতীয়ত, মাঝেরহাট সেতু তার কর্মক্ষমতা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছিল বলেই মনে করছেন বিশেষ়জ্ঞদের একাংশ। কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলা মানেই যে সেতু ভেঙে পড়া তেমনটা মোটেই নয়। তাঁদের মতে, এই সেতু দিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই অনেক ভারী ভারী যান চলাচল করে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সকল সেতুরই ভার বহনের ক্ষমতা কমে আসে। নিয়মিত তার স্বাস্থ্যপরীক্ষা করেই বিষয়টা নির্ধারণ করতে হয়। ৫০ বছর আগে যখন এই সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল, তখন যে পরিমাণ গাড়ি চলাচল করত, পাঁচ দশক পর তার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে ঠিক উল্টো হয়েছে। সেতুর যত বয়স বেড়েছে, তার উপর চাপ তত বেশি পড়েছে।
এমনকি, যে মালমশলা দিয়ে সেতু তৈরি করা হয়েছিল, এত বছর পরে সেগুলো তো ক্ষয়েও যায়। অনির্বাণের কথায়, ‘‘এই সব ক্ষেত্রে ইঞ্জিনিয়ারদের হিসাব কষে ‘ব্রিজ রেটিং অ্যানালিসিস’ করতে হয়। মাঝেরহাট সেতুর ক্ষেত্রে এমনটা করা হয়নি বলেই মনে হচ্ছে।’’ যে ভাবে মাঝেরহাট সেতু ভেঙে পড়েছে, তাতে পূর্ত দফতরের ইঞ্জিনিয়াররা যে সেই ‘ব্রিজ রেটিং অ্যানালিসিস’-এর কাজটা করে উঠতে পারেননি, সেটা ভীষণ ভাবে স্পষ্ট। পাশাপাশি, সেতুর কোনও অংশ দুর্বল হয়েছে কি না, হেলথ-অডিটে তা উঠে আসে। অনির্বাণের কথায়, ‘‘সেতু তৈরির পাঁচ বছর পর থেকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা দরকার।’’
বুধবার সকালেও চলছে উদ্ধারকাজ। ছবি: রয়টার্স।
চতুর্থত, দীর্ঘ এই পাঁচ দশক ধরে মাঝেরহাট সেতুতে যে ভাবে মেরামতির কাজ হয়েছে, সেটা খুব বিজ্ঞানসম্মত ভাবে হয়নি বলেও বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এ দিন সেতুর ভেঙে পড়া অংশ পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, পাঁচ দশক আগের মূল সেতুর কাঠামোর উপর যে স্টোনচিপের সঙ্গে বিটুমিনের প্রলেপ দেওয়া হয়েছিল, তার উপর বহু বহু বার একই প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। ফলে এই মুহূর্তে মূল কংক্রিটের প্লেটের উপর রাস্তা কোথাও এক ফুট, কোথাও কোথাও দু’-আড়াই ফুট উঁচু। অর্থাৎ, পুরনো জিনিসপত্র না সরিয়ে তার উপরেই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে মেরামতির মালমশলা।
আরও খবর
সেতু ভাঙার পর এখন কোন পথে যাতায়াত করবেন দেখে নিন
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ কারণে সেতুর ওজন দিনে দিনে একটু করে বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে গাড়ির ভার। স্থায়ী চাপের পাশাপাশি পরিবর্তনযোগ্য চাপও বেড়েছে মাঝেরহাট সেতুর উপর। তা হলে পূর্ত দফতর কোন নজরদারিটা রেখেছিল? কী ভাবেই বা দিয়েছিল ফিট সার্টিফিকেট?
আসলে উপরের সব ক’টি ক্ষেত্রেই আসলে দায় গিয়ে পড়ছে সেই পূর্ত দফতরের উপরেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই কারণগুলি হয়তো আলাদা আলাদা ভাবে সামান্য। কিন্তু, সব মিলিয়ে বিষয়টি অত্যন্ত ভয়ানক এবং বিপজ্জনক। পূর্ত দফতরের উদাসীনতা যদি এই পর্যায়ে পৌঁছয়, তা হলে শহরের বাকি সেতুগুলোর অবস্থা নিয়েও চিন্তা বাড়ছে বিশেষজ্ঞদের। শহরবাসীরও।
(কলকাতার ঘটনা এবং দুর্ঘটনা, কলকাতার ক্রাইম, কলকাতার প্রেম - শহরের সব ধরনের সেরা খবর পেতে চোখ রাখুন আমাদের কলকাতা বিভাগে।)