সমরজিৎ দাস।
সম্ভবত জানুয়ারিতেই কেরলে সংক্রমণ ছড়ানোর খবর পেয়েছিলাম। বুঝতে দেরি হয়নি যে সুনামির ঢেউ আছড়ে পড়তে চলেছে। মার্চে লকডাউন শুরুর দু’দিনের মাথায় জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এক রোগী এসেছিলেন। আমিই তাঁকে ধরে পরীক্ষা করি। করোনা সন্দেহ করে ভর্তির জন্য সিনিয়র দাদা এবং প্রফেসরের কাছে পাঠাই। তাঁরাও পরীক্ষা করে ভর্তি নিয়ে নেন। তখন সুরক্ষার জন্য বরাদ্দ শুধু মাস্ক। পিপিই তখন কোথায়? পরদিন ওই রোগীর করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট পজ়িটিভ আসে। তার পরদিন মারা যান। আমরা তিন জনে ১৪ দিনের কোয়রান্টিনে চলে যাই। এই ছিল অতিমারি পর্বে আমার হাতেখড়ি।
এর পরেই আর জি করে আইসোলেশন ওয়ার্ড, সারি ওয়ার্ড হয়। আমাদের অনেক প্রতিবাদ-দাবির পরে সুরক্ষার দিকটিও ধীরে ধীরে পোক্ত হয়। যোগ হতে থাকে করোনার সঙ্গে ঘর করার নিত্যনতুন অভিজ্ঞতাও। হস্টেলে সে দিন একসঙ্গে মুড়ি-চানাচুর মেখে খাচ্ছিলাম সবাই। স্বাস্থ্য ভবন থেকে একটি ফোন এল। ওই আড্ডায় বসে থাকা দুই সিনিয়রকে জানানো হল, তাঁরা পজ়িটিভ। সবার চোখে প্রশ্ন, তবে তো আমাদেরও কোয়রান্টিনে যেতে হবে? সাড়ে তিন ঘণ্টা পরে স্বাস্থ্য ভবন থেকে ফের ফোন। বলা হল, আগের ফোনটা ভুল ছিল। যার কারণ একই নামের ভুল। ওই ঘণ্টা কয়েকের আতঙ্ক নাড়িয়ে দিয়েছিল।
সংক্রমণ যত ছড়িয়েছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানসিক উদ্বেগ (অ্যাংজ়াইটি ডিজ়অর্ডার)। আমরা তরুণ। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক ভাবে বেশি বলেই বিশ্বাস। কিন্তু রোজ এত রোগী দেখার ফাঁকে তাঁদের কারও সূত্রে আমরা কোভিড-বাহক হয়ে অন্য অসুস্থ মানুষকে সংক্রমিত করে ফেলছি না তো! কিংবা পরিবারের বয়স্ক বা ছোটদের বিপদের কারণ হব না তো! এই আতঙ্কই গ্রাস করে চলেছে। যার প্রভাব পড়ছে ব্যক্তিগত জীবনে। সময় থাকা সত্ত্বেও প্রিয় জিনিসে তত মনোযোগ দিতে পারছি কোথায়? এই সব অস্থিরতার জন্য ওষুধ
খেতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন: বম্বে গ্রুপের রক্ত নিতে দাতার বাড়িতে ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্মীরা
মাসে এক বার দু’দিনের জন্য বাড়ি গেলেও বাবা-মায়ের থেকে দূরে থাকি। দোতলা জুড়ে একাই থাকি। মেশিনেই নিজের কাপড় কাচি। মা একটি নির্দিষ্ট জায়গায় খাবার রেখে যান। দূরত্ব-বিধি মানতে গিয়ে মায়ের স্পর্শ পাইনি বহু দিন। একসঙ্গে বসে খাওয়াও হয় না। বাবা-মাকে প্রণাম করিনি অনেক দিন। পুরুলিয়ার একটি কলেজের অধ্যাপিকা আমার হবু স্ত্রী। তাঁর সঙ্গে গত সাত মাস দেখাই হয়নি। ফোনই একমাত্র সাঁকো। তা-ও রোজ কথা বলার সময় কোথায়? দু’তরফেই মানিয়ে নিচ্ছি। তবে ওই পক্ষের অবদান নিঃসন্দেহে বেশি। এ সবটাই ওঁদের ভাল রাখার জন্য।
রোগীকে ভাল করার জন্য নতুন এই অতিমারি নিয়ে প্রথম দু’মাস প্রচুর পড়াশোনা করেছি। দেখলাম, ক্রমশ অবসাদ গিলে খাচ্ছে। এখন যে কোনও আড্ডায় আমরা সন্তর্পণে এড়িয়ে যাই কোভিড প্রসঙ্গ।
নিজেকে ভাল রাখতে সবাই যা করেন, আমরা, অর্থাৎ আবাসিক ডাক্তারেরা সেটুকুও পারি না। গার্গল করা, আদা চা, লেবু-জল, ফল এ সব খাওয়ার সময় বা মানসিকতা কোনওটাই আমাদের নেই। তবে ডাল, সয়াবিন, মাছ, মাংস, ডিম জাতীয় খাবার বেশি করে খাওয়া হচ্ছে। মনকে শান্ত করতে নিজস্ব জগতে ঘুরছি আজকাল। অস্ট্রিয়ার সুরকার ফ্রান্জ় পিটার শুবার্ট ও রাশিয়ার সুরকার পিওতর ইলিচ চাইকোভস্কির সুরে আপাতত মজে আছি। যন্ত্রণা ও বেদনার মুহূর্তের অসাধারণ সুরস্রষ্টা এঁরা। গিটার, মাউথ অর্গানে সুর ভাঁজি। ইরানের দুই নির্দেশক আসগর ফারহাদি ও আব্বাস কিয়ারোস্তামি আমার বরাবরের প্রিয়। এঁদের যাবতীয় সৃষ্টি খুঁটিয়ে দেখা শুরু করেছি। সিনেমা তৈরির প্রেক্ষাপট, গল্পের পটভূমি― সমস্ত। ভাবছি একটা ব্লগ শুরু করব। এই পর্বে এগুলোকেই প্রোটিন, ভিটামিন হিসেবে বেছে নিয়েছি। কারণ, এই লড়াই দীর্ঘ, মনকে জাগিয়ে রাখতে হবে।
(আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র চিকিৎসক)
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)