মধুসূদন এবং শিবানী শিকদার। নিজস্ব চিত্র
কথা ছিল, ডায়ালিসিসের যন্ত্র দান করবেন বৃদ্ধ দম্পতি। সেই যন্ত্র চালানোর জন্য যে পরিশোধিত জলের প্লান্ট প্রয়োজন, তার ব্যবস্থা করবেন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। শেষ জীবনের সঞ্চয় ভেঙে কথা রেখেছেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। কিন্তু ন’মাসেও জলের পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারেনি আর জি কর। যার জেরে ন’মাস ধরে গুদামে পড়ে আছে কয়েক লক্ষ টাকার সেই দামি যন্ত্র।
বনহুগলির বাসিন্দা, সাতাশি বছরের মধুসূদন শিকদার ক্যানসারে আক্রান্ত। সম্প্রতি কিডনির অসুখও ধরা পড়েছে। অশক্ত শরীর। অবলম্বন ছাড়া হাঁটতে পারেন না। তবু কষ্ট করে বনহুগলির বাড়ি থেকে প্রায়ই আর জি করে ছুটে যান তিনি। স্বাস্থ্য ভবনের একাধিক কর্তাকে ফোন করেন। প্রয়োজনে সল্টলেকে স্বাস্থ্য দফতরের সদর কার্যালয়ে যেতেও দ্বিধা করেন না। যদি ‘সুখবর’টা পাওয়া যায়। দীর্ঘ ন’মাস ধরে যে খবর শোনার জন্য মধুসূদন ও তাঁর স্ত্রী শিবানী শিকদার অপেক্ষা করে রয়েছেন। কিন্তু খবর আর আসে না!
বছর তিনেক আগের ঘটনা। ডায়ালিসিসের অভাবে ওই বৃদ্ধ দম্পতির এক নিকটাত্মীয় অ্যাম্বুল্যান্সেই মারা যান। মধুসূদনবাবু জানান, ওই আত্মীয়ের স্মরণে ২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল একটি ডায়ালিসিসের যন্ত্র আর জি কর হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগে দান করেন তাঁরা। বৃদ্ধের দাবি, সেই সময়ে হাসপাতালের চিকিৎসকদের একাংশ শিবানীদেবীকে জানান, ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) আর একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ডায়ালিসিসের যন্ত্র দান করলে রোগীরা উপকৃত হবেন। তৎক্ষণাৎ তাতে সম্মতি দেন শিবানীদেবী। স্ত্রীর ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে ওই যন্ত্র কেনার জন্য জার্মানির একটি সংস্থার সঙ্গে ই-মেলে যোগাযোগ করেন বৃদ্ধ। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা যন্ত্র দান করলেও তা চালাতে পরিশোধিত জলের জোগানে একটি প্লান্ট তৈরি করতে হত। সেই প্লান্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তৈরি করবেন বলেছিলেন। কিন্তু যন্ত্র চলে এলেও সেই প্লান্ট এখনও তৈরি হয়নি।’’
আর জি কর কর্তৃপক্ষের কথায় ভরসা করে বৃদ্ধ দম্পতি কিষাণ বিকাশ পত্র, ডাকঘরের সঞ্চয় ও স্থায়ী আমানত ভেঙে জার্মানির সংস্থাকে সাত লক্ষ টাকা ইতিমধ্যেই মিটিয়ে দিয়েছেন। বকেয়া যা রয়েছে, তার জন্য আরও একটি স্থায়ী আমানত ভেঙে তা মেটানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
কিন্তু তাঁদের সাধ পূরণে বাদ সেধেছে সরকারি কর্তাদের টালবাহানা। মধুসূদনবাবুর কথায়, ‘‘ওই যন্ত্রের সাহায্যে কোনও রকম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছাড়াই শিশু থেকে বৃদ্ধ, সকলের ডায়ালিসিস করা সম্ভব। জার্মানির সংস্থা প্রথমে দাম বলেছিল ১৬ লক্ষ টাকা। আমার উদ্দেশ্য জানতে পেরে কোনও রকম লাভ না রেখে মাত্র আট লক্ষ টাকায় তারা যন্ত্রটি আমাকে দিতে রাজি হয়েছে। এ দেশে আনার খরচও সংস্থাই বহন করেছে। বিদেশের সংস্থাকে সেবাধর্ম বোঝাতে আমাকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু নিজের দেশে এ রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে, তা ভাবিনি।’’ কথাগুলো বলার সময়ে গলা বুজে আসে বৃদ্ধের।
শিবানীদেবী বলেন, ‘‘যন্ত্রটা যাতে মানুষের কাজে লাগে, তার জন্য অশক্ত শরীরেও কোথায় যাইনি! আমার স্বামী ডান চোখে দেখতে পান না। এই বয়সে বাসে চড়ে আর জি করে ও সল্টলেকের স্বাস্থ্য ভবনে যান। ভাল কাজ করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হতে হবে ভাবিনি।’’ বৃদ্ধ জানান, সমস্যার সমাধান না হলে কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচালিত হাসপাতালকে ওই যন্ত্র দিয়ে দেবেন! তাঁর কথায়, ‘‘যন্ত্র আগলে আমরা বুড়োবুড়ি ক’দিন আর বাঁচব!’’
কিন্তু সরকারি প্রক্রিয়াতেই বা এত গড়িমসি চলছে কেন?
আর জি কর হাসপাতালের অধ্যক্ষ শুদ্ধোদন বটব্যাল বলেন, ‘‘উনি খুবই বড় মনের মানুষ। আমাদের হাসপাতালের শুভাকাঙ্ক্ষী। সরকারি নিয়মে দরপত্র ডেকে জল পরিশোধনের প্লান্ট তৈরি করতে সময় লাগছে। দরপত্রে অন্তত তিনটি সংস্থাকে অংশ নিতে হয়। তা না হওয়ায় এক বার দরপত্র ডেকে তা বাতিল করা হয়েছে। সেই কারণেই যন্ত্র যাতে পড়ে না থাকে, তার জন্য আপাতত নেফ্রোলজি বিভাগেই সেটি দেওয়ার কথা বলেছিলাম। কিন্তু উনি বলছেন, সিসিইউ ছাড়া তিনি যন্ত্র দেবেন না।’’ এ প্রসঙ্গে বৃদ্ধ জানান, আটতলার সিসিইউ থেকে তিনতলায় ডায়ালিসিস করানোর জন্য নিয়ে যেতে হয়। ওই সময়ে রোগীদের প্রচণ্ড কষ্ট হয়। সেই অভিজ্ঞতার শরিক হয়েছেন বলেই তাঁদের এই সিদ্ধান্ত।
অধ্যক্ষ বলেন, ‘‘সরকারি নিয়মে একটু সময় লাগছে ঠিকই। তবে দ্রুত সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।’’
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।