নিজস্ব চিত্র।
শিশুর জন্য লাল টুকটুকে একটি ফ্রক, হাতায় লেসের কাজ। উন্মুক্ত আকাশের তলায়, নদীর ধারে ছোট্ট একটা বাড়ি। প্রকৃতির মধ্যে আত্মহারা, পেখম মেলা ময়ূর। দিনের প্রথম সূর্যকে অভিবাদনরত বৃক্ষ-মানবী। ভাইবোনেদের নিয়ে পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে।
টুকরো টুকরো কাপড়ে এমনই স্বপ্ন এঁকেছেন ৩৫৪ জন নারী। তাঁদের আলাদা আলাদা পরিচয়ের মধ্যে একটি পরিচয় সকলের ক্ষেত্রেই এক। তা হল, তাঁরা সকলেই পারিবারিক হিংসা বা লিঙ্গ-হিংসার কবল থেকে বেঁচে ফিরেছেন। তাই বোধহয় আলাদা ভাবে আঁকলেও কোথাও গিয়ে মিলে যায় তাঁদের সব স্বপ্নেরা— একটা নিরাপদ আশ্রয়, একটু প্রকৃতির সান্নিধ্য, প্রিয়জনের সঙ্গ। টুকরো টুকরো কাপড় পাশাপাশি রেখে তৈরি হয় স্বপ্নের ট্যাপেস্ট্রি— খোলা আকাশের তলায়, নদীর ধারে, গাছে ঘেরা একটা ঘর। যা তাঁদের নিজস্ব জায়গা, যেখানে তাঁদের নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার আছে, যেখানে হিংসার কোনও স্থান নেই।
নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘স্বয়ম’-এর উদ্যোগে শনিবার ‘উইভিং ড্রিমস: উইমেন ইম্যাজিন এ ভায়োলেন্স ফ্রি ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক এই ট্যাপেস্ট্রির প্রদর্শনীর উদ্বোধন হল ভারতীয় জাদুঘরে। সঙ্গে রয়েছে নির্যাতন-পরবর্তী জীবনে এই নারীরা কী চান, তা নিয়ে অনুচ্ছেদ, কবিতাও।
এই সংগঠনের দৌলতেই চার জনের সঙ্গে অভিজ্ঞতা-তুতো বোনের সম্পর্ক পাতিয়েছেন মেটিয়াবুরুজের শগুফতা বানো। দশ বছরের দাম্পত্য হঠাৎই বদলে গিয়েছিল লকডাউন আর আর্থিক সঙ্কটের সাঁড়াশি চাপে। ৩০ বছরের দিশাহারা যুবতী এখন বলছেন, ‘‘এখানে এসে নিজেকে খুঁজে পেয়েছি, হিম্মত পেয়েছি নতুন করে বাঁচার।’’ নিজের পায়ে দাঁড়াতে ইংরেজি ও কম্পিউটারের কোর্স করেছেন শগুফতা। ডাক পাচ্ছেন ইন্টারভিউতেও। বছর আটত্রিশের কুহেলি মণ্ডলও বললেন, ‘‘এখানেই আমি মুখ ফুটে কথা বলতে শিখেছি। ভিন্ ধর্মে বিয়ে করার জন্য অনেক অত্যাচার সইতে হয়েছে। বোবা হয়েই থাকতাম। কিন্তু আমার মতো আরও অনেকের সঙ্গ সাহস জুগিয়েছে। এখন স্বামীকেও নিজের কথা, নিজের মতটা বোঝাতে পারি।’’ সকলের সঙ্গে বসে এই ট্যাপেস্ট্রি তৈরি করার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে গিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন দু’জনেই। বলেন, ‘‘আমাদের হাতের কাজ জাদুঘরে দেখানো হবে, প্রতিদিন কত লোক দেখবেন, সেটা ভেবেই আনন্দ হচ্ছে।’’
ঘরের হিংসা থেকে বেরোনোর পথের খোঁজ নিয়ে এই কাজ জাদুঘরের মতো গণপরিসরে দেখানোর প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে আনলেন কলকাতার গ্যেটে ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর অ্যাস্ট্রিড ওয়াগি। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করে তিনি বললেন, ‘‘নির্যাতনের সারভাইভরদের থেকেই আমাদের জানতে হবে, তাঁরা নিজেদের জন্য কী চান। আর সে কথা পৌঁছে দিতে হবে যত বেশি সম্ভব মানুষের কাছে।’’ সকলের স্বপ্ন একসঙ্গে সাজিয়ে দিয়েছেন শিল্পী ইয়ায়িল সিলিমান ও তৃণা সেন। তাঁদের কথায় উঠে এল সমষ্টিগত জোরের কথা। ইয়ায়িলের কথায়, ‘‘ছোট স্বপ্নগুলোকে একসঙ্গে জুড়ে আরও বড়, আরও শক্তিশালী রূপ দিতে হবে, যাতে কোনও এক জনের স্বপ্ন সকলের হয়ে উঠতে পারে।’’ আর তৃণা জানালেন, প্রদর্শনীতে সকলের সামনে উপস্থিত করে আসলে সম্মান জানানো হল সেই মেয়েদের ভাবনাকে, যাঁদের কথা কেউ শুনতে চায়নি।
আঁকা, গান, নাচের মাধ্যমে এ ভাবেই নির্যাতিতা মেয়েদের নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ করে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করলেন স্বয়মের ডিরেক্টর অনুরাধা কপূর। তিনি বলেন, ‘‘পরিস্থিতির চাপে গুটিয়ে যাওয়া মেয়েরা যে একটু সুযোগ পেলেই সৃজনশীল হয়ে উঠতে পারেন, তারই প্রমাণ এই ট্যাপেস্ট্রি। মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছনোর সহজ মাধ্যম হতে পারে শিল্প।’’ জাদুঘরের প্রি অ্যান্ড প্রোটো হিস্ট্রি হলে প্রদর্শনীটি দেখা যাবে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত। সোমবার ছাড়া অন্যান্য দিনে সকাল ১০টা থেকে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকবে এটি।