নাকতলার মণ্ডপে চলছে সেলাইয়ের কাজ। নিজস্ব চিত্র
দিদিমণি উদ্বোধনে আসছেন না! ২০১০-এর পরে এই প্রথম। “আমরা রীতি মেনে মুখ্যমন্ত্রীকে ডেকেছিলাম। ইমেলে। জবাব আসেনি। থানাও কিছু বলেনি। তাই ধরে নিচ্ছি…”, বলছিলেন নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘের পুজোর সাধারণ সম্পাদক অঞ্জন দাস ওরফে মিন্টু। এ পাড়ার ছেলে, রাজ্যের শাসকদলে একদা ‘নাম্বার টু’ তকমাধারী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের থাকাটাও এ বছর অসম্ভবই। তবে তাঁর উপস্থিতির থেকেও তীব্র এই অনুপস্থিতি। হেভিওয়েট মন্ত্রীহীন পুজোয় দুগ্গা এ বার মোটা কাপড় বিলোচ্ছেন।
মোটা কাপড় মানে খাদির মোটা সুতো! এ তল্লাটের উদ্বাস্তু মহল্লায় একটা প্রজন্মের মায়েদের জীবনযুদ্ধের হাতিয়ার সেলাই কলের সুতো। সেটাই পুজোর থিম! যা এ পাড়ার ইতিহাসেরও স্মারক। কিন্তু অতীতের সেই সংগ্রামগাথা ছাপিয়ে মাথাচাড়া দিচ্ছে কাঠখোট্টা বর্তমান। ২০১৯ সালের উদ্বোধনী আসরের ভিডিয়ো এখন ভাইরাল। মঞ্চে পুজোর দুই ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ও অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। অর্পিতাকে মুখ্যমন্ত্রী জিজ্ঞাসা করছেন ওড়িয়া ছবিতে অভিনয়ের কথা! “উড়িয়া বলতে পারো? এরা আমাদের কালচারাল ইন্ডাস্ট্রি!” পাশে লাজুক হাসছেন পার্থ। দু-দু’বার নাকতলার মুখ ছিলেন অর্পিতা। এ বার স্টেজ অনেক ছোট। পুজোকর্তা অঞ্জন বলছেন, “পার্থদা থাকলেও এ বার এটাই থিম হত। মাঠ এ ভাবেই সাজাতাম!”
২০১২ সালে পার্থ শিল্পমন্ত্রী থাকাকালীন নাকতলার পুজোর গেটের সংখ্যা ৩০ ছাড়িয়েছিল। সব পেরিয়ে ঢুকতেই পা ব্যথা। অঞ্জন বলছেন, “অত বেশি এক বারই! গত দু’-তিন বছরের সঙ্গে এ বারের হেরফের নেই। তবে শুরুটায় অসুবিধা হয়েছিল।” কী রকম? অঞ্জনের কথায়, “পার্থদা গ্রেফতার হওয়ার পরেই রটানো হয়, ক্লাবে ওই টাকা ঢুকেছে। তখন স্পনসরেরা পিছপা ছিলেন। ওঁদের বুঝিয়ে বলেছি! এখন তো অনেক বড় সংস্থা এসেছে। গেটও গোটা দশেক। শেষ মুহূর্তে কত আর্জি।” পুজোর বাজেট বড়জোর উনিশ-বিশ বলে দাবি করছেন অঞ্জন।
দু’বছর আগেও এ পুজোর কাপ্তেন, অধুনা পাশের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বাপ্পাদিত্য দাশগুপ্ত কিন্তু মৃদু হাসছেন, “১৫ বছর এই পুজোর ভালমন্দের সঙ্গে থেকেছি। ২৫-৩০ হাজারে গেট দিলে হাতে লাভ থাকে না। গেটের রেট সচরাচর এক লাখের কমে রাজিই হইনি!” তাঁর কথায়, “পার্থদার বা আরও আগে ক্ষিতিদার (বাম আমলের পূর্তমন্ত্রী ক্ষিতি গোস্বামী) থাকার সুবিধা অস্বীকার করা যাবে না। ক্ষিতিদা রাইটার্সে বসে সামনেই বিভিন্ন কর্পোরেটকে যা বলার বলতেন। পার্থদার স্টাইলটা আলাদা ছিল। আড়ালে বলতেন। তবে আমরা বললে যেটা পাঁচ হয়, ওঁরা বলা মানে পনেরো, এটাই বাস্তব!”
একদা কলকাতার ‘কোটি ক্লাবের’ পুজো হিসাবে নাম ছিল নাকতলারও। বাপ্পাদিত্য অবশ্য বলছেন, “বাজেটে কোটির গল্প দু’-এক বারই!” তবে বারোয়ারি পুজো মহল জানে, সুজিত বসুর শ্রীভূমি, অরূপ বিশ্বাসের সুরুচি সঙ্ঘ, ববি হাকিমের চেতলা অগ্রণী, উত্তরের চ্যালেঞ্জার টালা প্রত্যয়ের পাশে উদয়ন সঙ্ঘ এখন মধ্যবিত্ত।
মণ্ডপের পিছনে উদয়ন সঙ্ঘের তেতলা অফিসবাড়িটি হৃত কুলমর্যাদার প্রতীক। দোতলায় লেখা আছে অভিভাবক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আশীর্বাদের’ কথা। চুটিয়ে জিম চলছে। তা-ও ক্লাবের উপার্জনের সম্বল। অতীতে অর্থলগ্নি সংস্থার কেলেঙ্কারিতে নাকতলার পুজোকর্তাদের ডাকে ইডি, সিবিআই। ক্লাবের প্রাক্তন কর্তা বাপ্পাদিত্য গত বছর থেকেই এ পুজো ছেড়ে নিজের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডের পুজোয় মেতেছেন। পার্থের বাড়ির গলির কাছে যোগমায়া কালী মন্দিরের মণ্ডপও ‘এইটুকু’ হয়ে গিয়েছে। পার্থ সেখানেই অঞ্জলি দিতেন।
গর্বের মন্ত্রী-সংযোগ ভুলে এখন ঘুরে দাঁড়ানোর মরিয়া চেষ্টা। গান্ধী, বিদ্যাসাগরের গল্পে মণ্ডপে মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়ের থিম শিল্পী প্রদীপ দাসের। তিনি বিরক্ত, “পার্থদাকে নিয়ে প্রশ্নে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছি! ও সব ভুলে কাজটা দেখুন!”