অবাধ (সন্ত্রাসে) ভোট

মমতা বলছেন শান্তিপূর্ণ, মানতে নারাজ কমিশনই

আয়োজনে ত্রুটি ছিল না। অনুষ্ঠানও সঙ্গতিপূর্ণ! কলকাতা পুরভোটের প্রচারপর্বেই বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছিল, বাইরের লোকজন জুটিয়ে, বোমা-গুলি মজুত করে ভালমতো প্রস্তুতি সেরে রেখেছে রাজ্যের শাসক দল। শনিবার ভোটের মাঠে কার্যত খড়কুটোর মতো উড়ে যাওয়ার পরে তাদের দীর্ঘশ্বাস: ‘ভোটের নামে প্রহসন হয়েছে’। বুথ দখল, থেকে শুরু করে বহিরাগতদের তাণ্ডব, গুলি-বোমা— কিছুই বাদ যায়নি। বস্তুত, এ দিন কলকাতা শহর ছিল কার্যত তৃণমূলের দখলে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২১
Share:

আনন্দপুর এলাকায় আক্রান্ত সিপিএমের স্থানীয় নেতা আশু দে। শনিবার শশাঙ্ক মণ্ডলের তোলা ছবি।

আয়োজনে ত্রুটি ছিল না। অনুষ্ঠানও সঙ্গতিপূর্ণ!

Advertisement

কলকাতা পুরভোটের প্রচারপর্বেই বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছিল, বাইরের লোকজন জুটিয়ে, বোমা-গুলি মজুত করে ভালমতো প্রস্তুতি সেরে রেখেছে রাজ্যের শাসক দল। শনিবার ভোটের মাঠে কার্যত খড়কুটোর মতো উড়ে যাওয়ার পরে তাদের দীর্ঘশ্বাস: ‘ভোটের নামে প্রহসন হয়েছে’। বুথ দখল, থেকে শুরু করে বহিরাগতদের তাণ্ডব, গুলি-বোমা— কিছুই বাদ যায়নি। বস্তুত, এ দিন কলকাতা শহর ছিল কার্যত তৃণমূলের দখলে। বিরোধীরা শক্তিহীন হওয়ায় রক্ত হয়তো তেমন ঝরেনি। কিন্তু সন্ত্রাসের মাত্রা কিছু কম ছিল না। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের গতিবিধি অবাধ করে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় বাহিনীর অনুপস্থিতি আর পুলিশের দর্শক আসনে চলে যাওয়া। শাসকদলের দাপাদাপিতে ভোটও পড়েছে অন্য বারের তুলনায় বেশ কম।
এই সব অভিযোগের সারবত্তা মেনে নিয়েছেন খোদ রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘আদর্শ পরিবেশে ভোট হলে এত অভিযোগ আসত না।’’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বিরোধীদের অভিযোগ বা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষণ কিছুই মানতে নারাজ। ভোট শান্তিপূর্ণ হয়েছে দাবি করে তিনি যাবতীয় কৃতিত্ব দিয়েছেন পুলিশকে। ধন্যবাদ জানিয়েছেন সব রাজনৈতিক দলকে।
এহেন দাবি, পাল্টা দাবির মাঝে শনিবার কী দেখল শহর কলকাতা?

সকাল সাতটায় ভোটপর্ব শুরুই হয়েছিল কুঁদঘাটের ১১৪ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএম-তৃণমূল সংঘাত দিয়ে। এর পর বাঘাযতীনে সিপিএম এজেন্টকে হুমকি, গাঙ্গুলিবাগানে সিপিএম কর্মীকে মার, মানিকতলায় নির্দল প্রার্থীকে আক্রমণ, বিজেপি প্রার্থী মীনাদেবী পুরোহিতকে ধাক্কাধাক্কি, সিপিএম নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের ছেলে সাম্যকে নিগ্রহ— বেলা যত গড়িয়েছে ততই আরও তপ্ত হয়েছে শহরের হাওয়া। সকাল এগারোটায় বোমাবাজি হয় রাজভবনের মতো ভিভিআইপি এলাকার কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটে। গুলি চলে ভারতীয় জাদুঘরের সামনে, বাঘাযতীনে এবং পার্ক সার্কাসে। চৌরঙ্গি লেনে সিপিএম নেতা ফুয়াদ হালিমকে লক্ষ করে গুলি চলে বেলা পৌনে একটা নাগাদ। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্যাম্প অফিস ভাঙচুর, বুথ দখল, ভোটারকে ঘাড়ধাক্কা, নকল ভোট, ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ তো ছিলই। ভোটপর্ব চুকেবুকে যাওয়ার পরেও বিকেল সাড়ে চারটেয় গিরিশ পার্কে কংগ্রেস-তৃণমূল ঝামেলা থামাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন কলকাতা পুলিশের সাব ইনস্পেক্টর। এবং অধিকাংশ ঘটনাতেই কাঠগড়ায় রাজ্যের শাসক দল।

Advertisement

অথচ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক থেকে জনমত সমীক্ষা, কেউই বলেনি যে কলকাতার পুরভোট তৃণমূলের পক্ষে কঠিন লড়াই হতে যাচ্ছে। বরং একশোর উপরে আসন পেয়ে ফের ছোট লালবাড়ির দখল নিতে যাচ্ছে তারা, এমন ইঙ্গিতই ছিল। তার পরেও এমন কাণ্ড কেন?

তৃণমূল সূত্র বলছে, বিরোধীদের এক ইঞ্চি জমিও না-ছেড়ে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখলের মানসিকতা একটা কারণ। দ্বিতীয় কারণ, বাম ভোটের বৃদ্ধি। জনমত সমীক্ষা বলছে, লোকসভা ভোটের পরে কলকাতা শহরে বিজেপির হাওয়া বেশ খানিকটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। তার বদলে উত্থান হয়েছে বামেদের। তাদের ভোটপ্রাপ্তির হার ৩০ শতাংশ ছুঁয়ে ফেলতে পারে। সারদা, লেক মল, ত্রিফলা কেলেঙ্কারির আবহে এই হার যদি আর ৫ শতাংশ বেড়ে যায় তা হলে যে সমূহ বিপদ, সেটা বিলক্ষণ জানেন তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব। আগামী বছরের বিধানসভা ভোটের আগে তা বামেদের বাড়তি অক্সিজেনও দিয়ে যাবে। তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, ‘‘বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করে যতটা ভোট বাড়িয়ে নেওয়া যাবে, ততই আমাদের পক্ষে মঙ্গল। তাই সে ভাবেই রণকৌশল তৈরি করা হয়েছিল। আর তা সফলও হয়েছে।’’

কী ছিল শাসক দলের রণকৌশল?

বিরোধীদের অভিযোগ, অনেক দিন আগে থেকেই এলাকায় এলাকায় হুমকি দিয়ে সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি করে রেখেছিল তৃণমূল। শুধু বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদেরই শাসায়নি তারা, বেচাল দেখলে ফল ভাল হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল সাধারণ ভোটারদেরও। ভোটের আগের দিন ফের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি, এমনকী ভোটার কার্ড কেড়ে নেওয়ার অভিযোগও এসেছিল বহু জায়গা থেকে। পাশাপাশি, পিছিয়ে থাকা এলাকাগুলিতে বহিরাগতদের জড়ো করেছিল তৃণমূল। বৃহস্পতিবার থেকেই অপরিচিত মুখের ভিড় নিয়ে পুলিশ ও নির্বাচন কমিশনের কাছে নালিশ জানাচ্ছিলেন বিরোধীরা।

শনিবার সেই বহিরাগতরাই ভোটের মাঠ দাপিয়ে বেড়ালেন বলে অভিযোগ। আগে থেকে তৈরি হওয়া অশান্তির আবহে অনেকেই বুথমুখো হননি এ দিন। ফলে অন্যান্য বারের তুলনায় এ বার ভোট পড়েছে অনেক কম। ৬২ শতাংশের কাছাকাছি। (যার মধ্যে আবার বেশ কিছু ‘জল’ অর্থাৎ নকল ভোট আছে বলে কবুল করছেন শাসক দলের নেতারাই।) যাঁরা ভোট দিতে গিয়েছেন তাঁদের অনেকেই বলেছেন, বুথের মধ্যে অবাধে ঘুরে বেড়িয়েছেন পরিচয়পত্রহীন লোকজন। কোথাও কোথাও শাসক দলের প্রতিনিধি, এমনকী ভোটকর্মীরাও হয় নিজেরাই ভোট দিয়ে দিয়েছেন বা ভোট দেওয়ার সময় নজরদারি চালিয়েছেন বলে অভিযোগ। কোথাওই পুলিশকে

জানিয়ে কোনও ফল হয়নি বলে ভোটারদের দাবি।

মুখ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, ‘‘এ দিনের ভোটে ম্যান অব দ্য ম্যাচ পুলিশ-ই।’’ গিরিশ পার্কে গুলিবিদ্ধ এসআই জগন্নাথ মণ্ডলকে দেখতে হাসপাতালে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘১৪৪টা ওয়ার্ডে ভোট হয়েছে। মাত্র চার-পাঁচটা জায়গায় ছোটখাটো গোলমাল হয়েছে। বিরোধীরা যে সব জায়গায় এত দিন ভোট করিয়েছে, সেখানে তারা মাথা তুলতে পারছে না। জনগণ তাদের প্রতিহত করছে। তাই তারা গন্ডগোল পাকিয়ে শাসক দলের উপরে সেই দায় চাপাচ্ছে।’’ নির্বাচন কতটা শান্তিপূর্ণ হয়েছে তা বোঝাতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, রাস্তাঘাট এত শান্তিপূর্ণ ছিল যে, কোথাও উত্তেজনার ছবিই ছিল না।

কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর দাবির বিরোধিতা করেছেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনারই। সুশান্তবাবুর কথায়, ‘‘আদর্শ পরিবেশে ভোট হয়নি।’’ তিনি জানান, সচিত্র পরিচয়পত্র কেড়ে নেওয়া, বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট, ভোটারদের লাইন থেকে বের করে দেওয়ার মতো অভিযোগ উঠেছে। যে পরিবেশে ভোট হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষ স্বাধীন ভাবে তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি, এমন অভিযোগও তিনি পেয়েছেন। ‘‘আদর্শ পরিবেশে ভোট হলে এত অভিযোগ আসত না,’’ বলেছেন সুশান্তবাবু।

যা শুনে শাসক দলের নেতাদের পাল্টা প্রশ্ন, যত ক্ষণ ভোট হচ্ছিল, কমিশন কোথায় ছিল? ভোট অবাধ করার দায়িত্ব তো কমিশনেরই। কমিশনকে দুষেছেন বিরোধীরাও। বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, ‘‘কমিশন যথাযথ দায়িত্ব পালন করেনি। ডব্লিউবিসিএস অফিসার দিয়ে ভোট হয় না।’’ ২৫টি ওয়ার্ডে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়ে সিপিএম বলছে, ভোট-পরিবেশ নিয়ে এই পর্যবেক্ষণের পরে নির্বাচন কমিশন কত বুথে ফের ভোট করায়, সেটাই দেখার। আর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, কলকাতা পুরভোট যে সন্ত্রাসপূর্ণ হবে, তা তাঁরা আগেই আশঙ্কা করেছিলেন। সেই আশঙ্কা সত্যি হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘তৃণমূল নেত্রীকে এত সন্ত্রাসের উপর নির্ভর করতে হল কেন, বাংলার মানুষ সে প্রশ্ন করবে।’’

প্রশ্ন উঠেছে তৃণমূলের অন্দরেও। প্রথম প্রশ্ন এটাই যে, জুলুমের জোরে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা আদৌ সুফল দেবে কি? কলকাতার এক শীর্ষস্থানীয় তৃণমূল নেতার মন্তব্য ‘‘আজ যা হল তাতে হয়তো আমরা আরও দশটা আসন বেশি পাব। কিন্তু সেই জয়ে কাঁটার জ্বালা অনেক।’’ দ্বিতীয় প্রশ্ন, ভোট মেশিনারির ব্যর্থতাতেই কি এমন ভাবে প্রকাশ্যে এসে গেল সন্ত্রাস? আর এই প্রসঙ্গেই উঠে আসছে মুকুল রায়ের নাম। শাসক দলের কারও কারও ব্যাখ্যা, প্রস্তুতিপর্ব থেকে ভোটের দিন পর্যন্ত মুকুল এমন পরিকল্পনা ছকে চলতেন যে, জুলুম হলেও তা সাদা চোখে বোঝা যেত না।

ভোট-মাস্টারের গরহাজিরাতেই কি বেআব্রু শাসকদল?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement