প্রতীকী ছবি।
ছিল জনতা, হল দর্শক! বা ছিল পদধ্বনি, হল উঁকিঝুঁকি। কিংবা ইংরেজিতে চেনা লব্জে— ঘড়ির কাঁটা ধরে ‘ফুটফলের’ হিসাব পাল্টে হয়েছে ‘ভিউয়ারশিপ’। অতিমারির নব্য স্বাভাবিকতায় এটাই কি হতে চলেছে মোক্ষলাভের নয়া সূত্র?
বুধবার মহালয়ার বিকেলে অনেকটা তেমনই ইঙ্গিত টালা পার্কের একটি পুজোর গ্লোবাল ওপেনিংয়ে। টুইটার ট্রেন্ডিংয়ে গোটা দেশেই কয়েক ঘণ্টা ধরে শীর্ষে দেখা যায় তাদের। #আনরেস্ট্রিক্টেড২১ বা নির্বাধ ডাক দিয়ে বেড়া ভাঙার কথা বলছে টালা প্রত্যয়। অতিমারির শৃঙ্খলে পদে পদে বন্দিদশার আবহেই এ যেন পুরোদস্তুর উল্টো স্রোতে হাঁটা। এই পুজোর প্রচার দেখা যাচ্ছে নিউ ইয়র্কের সব থেকে দামি বিজ্ঞাপনী পরিসর টাইমস স্কোয়ারের ম্যাজিক প্যানেলে। উদ্বোধনী পর্বে প্যারিসের লুভ বা লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজ়িয়ামকেও আহ্বান জানানো হয়েছে। সবাইকে নেট-মাধ্যমে কলকাতার উৎসবে বিরাট একটি স্থাপনা-শিল্প দেখার আহ্বান। অর্থাৎ করোনা-কালের কলকাতায় বিধিনিষেধের আবহে গোটা দুনিয়ায় পৌঁছবে সেই উচ্ছ্বাসের ছোঁয়া।
অনেকটা একই ধাঁচে কলকাতার গত দু’দশকের বড় পুজো নিউ আলিপুরের সুরুচি সঙ্ঘও ‘দুয়ারে সুরুচি’ প্রকল্পে জোর দিচ্ছে। পুজোর অন্যতম কর্ণধার স্বরূপ বিশ্বাসের কথায়, “২০২০-র আগে থেকেই ওয়েবসাইটে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় পুজো-প্রচারে আমরা জোর দিচ্ছি। আর এ বছর তো বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। সুরুচির পুজোয় অঞ্জলি থেকে সিঁদুর খেলা— সব কিছুতেই অনলাইন পরিসরে শামিল হওয়া যাবে। আমাদের পুজোর প্রতিটি ফেসবুক লাইভেই সাক্ষী থাকেন
অন্তত ৫০-৬০ হাজার জন!” অর্থাৎ জনতার দাপাদাপি, কলকাকলির বাইরের একটা জীবন এ বছর আরও জোরালো ভাবে খুঁজে নিচ্ছে কলকাতার পুজো।
এ ছাড়া উপায়ই বা কী? তবে সার্বিক ভাবে ট্যাঁকের টানাটানি আছে ভালই। দু’এক জন শাঁসালো পৃষ্ঠপোষকের বদলে সমান বা কাছাকাছি অঙ্কের টাকা পেতে দশ জন অর্থদাতার খোঁজেও যেতে হচ্ছে। তবু সঙ্কটেই খোঁজ মিলছে নতুন
রাস্তার। দক্ষিণ কলকাতার ত্রিধারা সম্মিলনীর দেবাশিস কুমার বা হিন্দুস্থান পার্ক সর্বজনীনের সুতপা দাস বলছেন, ২০১৯-এর পুজোকে যদি দশের মাপকাঠিতে ধরা হয়, তবে আর্থিক আনুকূল্যের নিরিখে ২০২০ ছিল ৩-৪, ২০২১ ৫-৬-এ উঠেছে। ফলে শহরের বড়-ছোট সব পুজোরই বাজেট কমেছে। তবে কলকাতার ৩৫০টি পুজো কমিটির জোট ‘ফোরাম ফর দুর্গোৎসবে’র কর্তা তথা হাতিবাগান সর্বজনীনের শাশ্বত বসু কিছুটা নিশ্চিন্ত, পরিস্থিতি গত বারের থেকে ভাল। পুজোর গেট বা ব্যানারের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। উত্তরের কাশী বোস লেনের সোমেন দত্ত বলছেন, বিজ্ঞাপনের রেট কমলেও গেটের সংখ্যা ২০১৯-এর প্রায় কাছাকাছিই। বালিগঞ্জ কালচারালের তরফে অঞ্জন উকিল বলছেন, “সমস্যাটা অন্য জায়গায়! ২০২০-র থেকে পরিস্থিতি একটু হলেও ভাল, পুজো কমিটিগুলোও আগে থেকে পরিস্থিতি আঁচ করে খোলামেলা মণ্ডপ বা দূর থেকে দেখার বড় ঠাকুরের পথে হেঁটেছে। কিন্তু এক বার বিজ্ঞাপনের রেট কমে গেলে সহজে বাড়তে চায় না। ওষুধ সংস্থা বা বেশ কিছু খাবারদাবার গোছের পণ্য অতিমারিতে ভালই লাভ করেছে। তবু বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে মুঠো আলগা নয়!”
তবু এই পরিস্থিতিতেও গুটিকয়েক পুজো পৃষ্ঠপোষক টানায় এগিয়ে। শিবমন্দিরের পার্থ ঘোষের দাবি, “পরিস্থিতি ২০২০ সালের থেকে ভাল! আর পুজোর প্রচারটা নেটমাধ্যমেও সমান তালে চলছে।” একটি সর্বভারতীয় খাদ্যপণ্য
সংস্থার কর্তা অরিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “উত্তর ও দক্ষিণ মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত এ বার ২০১৯-এর সমান সমান লগ্নিই করেছি।” মেলা ও উৎসব বিষয়ক উপদেষ্টা ধ্রুবজ্যোতি বসুর কথায়, “পুজোর পৃষ্ঠপোষকতার চরিত্র পাল্টেছে। গেট, ব্যানারের সঙ্গে ভার্চুয়াল প্রচারকে মিলিয়ে গুটিকয়েক পুজো প্রায় প্রাক্-করোনা যুগের সমান আয়ও করে ফেলেছে। তা ছাড়া কলকাতার পাশাপাশি বিদেশে পুজোর প্রচারও কাজের। তাতে সার্বিক ভাবে কলকাতার পুজোর সদর্থক ভাবমূর্তিই গড়ে উঠছে।”