উৎসবের ছবিতে ভয়। নিজস্ব চিত্র
অতিমারির ভয়াল পটভূমিতে উৎসবের বীভৎস মজা কী অদ্ভুত ভাবে ফুটে উঠল ছবিটায়!কালো চার্ট পেপারে দুর্গার পিছনে আচমকাই অবচেতনের সেই ভয়ার্ত মুখটা ঠেলে বেরিয়ে এল। পাভলভ মানসিক হাসপাতালে পড়ে থাকা মাতৃস্নেহবুভুক্ষু এক তরুণ কী ভেবে দুর্গার পিছনে এডভার্ড মুঙ্কের বিখ্যাত ‘দ্য স্ক্রিম’-এর মুখটাই চালচিত্রের মতো বসিয়ে দিলেন। পুজোর সকালে পাভলভের চা-ঘরের কাছের স্থাপনাশিল্পে সেই অদ্ভুত প্রতিমার দৃশ্য। হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সরা আলোচনা করছিলেন, ‘‘কী আশ্চর্য! এ বারের উৎসবে মিশে থাকা ভয়ের সুরটা এত স্পষ্ট আর কেউ ধরতে পারল না।’’
পাভলভের ‘মনোরোগী’ তকমার এই ব্রাত্যজনেদের চেতনাতেও ঘা মারে দুর্গোৎসব। প্রতি বারের মতো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ‘দিদিদের’ সঙ্গে মণ্ডপে ঘোরাঘুরি আর হবে না। তবু এ বছর যেন মা দুগগা নিজেই এলেন তাঁদের ঘেরাটোপের জগতে। টুকাই, দেবাশিস, জয়ন্ত, সুকর্ণ, চন্দ্রশেখরেরা মিলে ফুটিয়ে তুললেন তাঁদের মনের দুর্গাকে।
পাভলভের আবাসিকদের শিল্পচর্চার তালিমের সঙ্গে যুক্ত নবেন্দু সেনগুপ্ত বলছিলেন, ‘‘আমি কিন্তু ওঁদের কিছু বলে দিইনি। তবে ওঁরা রবীন্দ্রনাথ, অবন ঠাকুর, গণেশ পাইনের পাশাপাশি রেমব্রান্ট, পিকাসো, মাতিসের ছবিও দেখেন। মুঙ্কের ছবিটাও কখনও দেখেছেন।’’ কয়েক দিন ধরে ছবিটা অনেকে মিলে আঁকতে আঁকতে দুর্গার পিছনে ওই ভয় পাওয়া অবয়বও বসানো হল। মহিলা ওয়ার্ডের সংহিতা, সর্বাণী, কবিতা, সম্বরীদের চোখেও পটচিত্রের আদলে দুগগাঠাকুর ফুটে উঠছে। সেই দুর্গাকে ঘিরে জটলায় মাস্ক পরা ভিড়।
বছর দুয়েক আগে শহরের খোলা জায়গায় স্থাপনা-শিল্পের একটি প্রকল্পে শরিক হয়েছিলেন পাভলভের আবাসিকেরা। তখনও সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষগুলোর চোখে ফুটে উঠেছিল জীবনের অন্য রকম ছবি। যেমন, খুব পরিপাটি স্বপ্নের বাড়ির ছবি আঁকতেন সীতা। তিনি এখন অনেকটা সংহত অবস্থায় বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। অতিমারি-ধ্বস্ত এই ঘরবন্দি উৎসবের গুমোট দশা নতুন করে পাভলভের আবাসিকদের শিল্প চেতনায় টান দিচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আধিকারিক শুক্লা দাসবড়ুয়া এই স্বভাব-শিল্পীদের কাছ থেকে দেখেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এঁদের রোগী হিসেবে দেখা ভুল। ওঁদের ভিতরের মানুষ সত্তাকে বার করে আনায় জোর দিই। তাই শিল্পকলার সঙ্গে ওঠাবসা।’’
এই দেবীপক্ষে লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতাল ও পাভলভে একটি দিন বড় পর্দায় শহরের বিভিন্ন পুজোর প্রতিমা দেখেছেন আবাসিকেরা। নিজেরা নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও করেছেন। তার পরে একসঙ্গে বিরিয়ানির আবেশ। পুজোর ছুটির হাওয়া এ ভাবেই ঢোকে পরিবার ও সমাজ থেকে ছিটকে যাওয়া, কার্যত বন্দি মানুষগুলোর জীবনে।
পুজোর ক’টা দিন পাভলভ জুড়ে শুধুই আবাসিকদের শিল্পকাজ। আপেল, কমলালেবুর পেটি রঙে ভরিয়ে, পোড়ামাটির জালায় কাগজের মণ্ড ঠেসে তাতে চোখমুখ এঁকে, বাঁশের বাখারি চেঁছে হাত-পায়ের আদল এনে মনের বল্গাহীন সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন তথাকথিত মনোরোগীরা। চর্চিত ললিতকলার কৃত্রিমতা ছাপিয়ে সেই শিল্পে স্বতঃস্ফূর্ততার আনন্দ।
মনোরোগীদের অধিকার রক্ষাকর্মী রত্নাবলী রায় বলছিলেন, ‘‘আমি খুব আশাবাদী, এক দিন কোনও বড় মণ্ডপের থিমে এই মানুষগুলোর শিল্পকাজ মেলে ধরা হবে। শিল্পই পারে এই আবাসিকদের সকলের সঙ্গে মেলাতে।’’ শিল্পের হাত ধরে স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক বলে দেওয়াল তোলা অবান্তর খোপগুলো কখনও খানখান হবে। আশঙ্কার উৎসবেও দানা বাঁধছে আশা।