হাতে কার্ড, তবু শোনা হল না গুলামের গান

ভিতরে তখন কলকাতাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিচ্ছেন গজলের ‘শাহেনশাহ’! বলছেন, ‘‘এটা কথার কথা নয়! হকিকত। কানাডা, আমেরিকা যেখানে যা-ই, বলি সব থেকে দরদি শ্রোতারা হল কলকাতার।’’ মঙ্গলবার সন্ধেয় ঠিক তখনই শয়ে-শয়ে জনতা তাদের প্রিয় শিল্পীকে এক পলকও না-দেখে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:২০
Share:

এক মঞ্চে। গুলাম আলি এবং মহেশ ভট্টের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

ভিতরে তখন কলকাতাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিচ্ছেন গজলের ‘শাহেনশাহ’! বলছেন, ‘‘এটা কথার কথা নয়! হকিকত। কানাডা, আমেরিকা যেখানে যা-ই, বলি সব থেকে দরদি শ্রোতারা হল কলকাতার।’’

Advertisement

মঙ্গলবার সন্ধেয় ঠিক তখনই শয়ে-শয়ে জনতা তাদের প্রিয় শিল্পীকে এক পলকও না-দেখে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকের হাতে এমনকী ‘ভিআইপি’ আমন্ত্রণপত্রও রয়েছে। কিন্তু ভিতরে তিল ধারণের ঠাঁই নেই বলে পুলিশ ফটক বন্ধ করে দিয়েছে।

ভিতরে ‘পারা পারা হুয়া’ ধরার সময়ে প্রবীণ শিল্পী বোঝাচ্ছিলেন, উর্দু শব্দ ‘পারা পারা’ মানে হল টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া। পাকিস্তান থেকে আসা উপমহাদেশের অন্যতম সেরা গজল-শিল্পী গুলাম আলি তখনও জানতে পারেননি, বাইরে বিফল মনোরথ বহু শ্রোতার কলজেও কষ্টে ছিঁড়েখুঁড়ে যাচ্ছে।

Advertisement

সপ্তাহখানেক ধরে গোটা দেশ জুড়ে চর্চিত এবং প্রতীক্ষিত সুর-সন্ধ্যায় এ ভাবেই কিছুটা সুর কাটল। হাতে বৈধ আমন্ত্রণপত্র থাকা সত্ত্বেও বিপুল দর্শক কেন ঢুকতে পারলেন না? লালবাজারের কর্তারা সরাসরি জবাব এড়িয়ে ঠারে-ঠোরে মেনেছেন, নির্দিষ্ট আসন-সংখ্যার থেকে বেশি কার্ড ছাপিয়েছিল অনুষ্ঠানের আয়োজক, রাজ্যের সংখ্যালঘু ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিষয়ক দফতর। লালবাজারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষকর্তার কথায়, ‘‘কী করব? বেশি কার্ড ছাপানোর দায় তো আমাদের নয়। আরও লোক ঢুকলে অনুষ্ঠানটাই ভন্ডুল হয়ে যেত।’’ অনেকে অনুষ্ঠান দেখতে পাননি জেনে রাজ্য সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের চেয়ারম্যান তথা সাংসদ সুলতান আহমেদ দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তবে তাঁর দাবি, ‘‘আমরা বাড়তি আমন্ত্রণপত্র বিলি করিনি।’’ কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানের সঙ্গে এই দাবির ফারাক আকাশ-পাতাল।


স্টেডিয়ামের বাইরে ভিড় সামলাতে ব্যস্ত পুলিশ। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

পুলিশেরই বক্তব্য, নেতাজি ইন্ডোরে কমবেশি বারো হাজার লোকের বসার বন্দোবস্ত রয়েছে। এ দিন ভিতরে ঢুকেছিলেন হাজার পনেরো দর্শক। তার পরেও বহু মানুষ হাতে কার্ড নিয়ে বাইরে থেকে যান। অনেকেরই মনে পড়েছে, তিন বছর আগে ইডেনে অবাধে প্রবেশের সুযোগ পেয়ে শাহরুখ খানকে দেখতে জনবিস্ফোরণ সামলাতে পুলিশকে লাঠি চালাতে হয়েছিল। চলচ্চিত্র উৎসব উদ্বোধনী আসরে এই নেতাজি ইন্ডোরেই কার্ড হাতে নিয়ে বিফল হওয়ার নজির আছে। পুলিশের এক শীর্ষকর্তার কথায়, ‘‘ভুল থেকে শিক্ষা না নিয়েই সরকার বারবার সমস্যার সৃষ্টি করছে।’’ পুলিশের এক কর্তার বক্তব্য, ‘‘এ বার প্রথমে পার্কসার্কাস ময়দান, ইডেন, মোহনবাগান মাঠ নিয়ে জল্পনার পরে অনুষ্ঠান হয়েছে নেতাজি ইন্ডোরে। ফলে কত আমন্ত্রণপত্র ছাপা হবে, তা নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল।’’ আবার আমন্ত্রণপত্র ছাড়াই দলও প্রশাসনের উপরতলার ঘনিষ্ঠদের ভিতরে ঢুকতে দিতে হয়েছে। সেটাও বৈধ কার্ডধারীদের সমস্যা বাড়িয়েছে। যাঁরা ঢুকতে পারেননি তাঁদের জন্য ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে ‘জায়ান্ট স্ক্রিন’-এর বন্দোবস্ত ছিল। কিন্তু দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে অনেকেরই মন সরেনি। পুলিশ কর্তারা অবশ্য মনে করাচ্ছেন, কার্ডে সকলকে বিকেল সাড়ে চারটের মধ্যে আসতে বলা হয়েছিল আর ইন্ডোরের দরজা এ দিন বন্ধ করা হয় সওয়া পাঁচটার পরে।

দেশ জুড়ে অসহিষ্ণুতা নিয়ে অভিযোগের আবহে গুলাম আলিকে কলকাতায় এনে কেন্দ্রে বিজেপি সরকারকে রাজনৈতিক ভাবে টেক্কা দিতে চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিবসেনা মুম্বইয়ে শিল্পীর অনুষ্ঠান বাতিল করে দেওয়ার পরে অভিমানে ভারতে আর কখনও গাইবেন না বলে দিয়েছিলেন গুলাম। শেষমেশ মমতার ডাকে কলকাতায় এসে শিল্পী এ দিন বলেন, ‘‘কলকাতায় এত বার এসেছি! তবু এ বার মনে হচ্ছে যেন ৫০ বছর বাদে এলাম!’’ অভিভূত হয়ে মমতাকে ‘দেবী সরস্বতী’ও বলেন তিনি। মুম্বই-কাণ্ডের পরে এই অনুষ্ঠানকে ‘অলৌকিক’ আখ্যা দিয়ে চিত্রপরিচালক মহেশ ভট্টও মঞ্চে বলেন, ‘‘মমতাজির জন্য ভারতীয় হিসেবে গর্ব হচ্ছে।’’ কিন্তু পরিকল্পনার খামতিতে এমন গর্বের সন্ধ্যাতেও শহরের মুখ পুড়ল বলে পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারাই জনান্তিকে মানতে বাধ্য হলেন।

ডামাডোল পেরিয়ে যাঁরা ভিতরে ঢুকতে পেরেছিলেন, গুলাম আলির গান অবশ্য তাঁদের মন ভরিয়েছে। গুলাম আলির পুত্র আমির আলি খানও কিছু ক্ষণ বাবার সঙ্গে গান করেন। সন্ধ্যার সেরা মুহূর্তটি একেবারে শেষের জন্য তোলা ছিল। ধন্যবাদ-জ্ঞাপন পর্বে কলকাতার রাশিদ খান যখন উদাত্ত স্বরে ধরলেন ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’! এগিয়ে এসে তাঁর সঙ্গে গলা মেলালেন গুলামও। সুরের মেলবন্ধন সম্পূর্ণ হল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement