বিশ্ব শ্রবণ দিবসের এক অনুষ্ঠানে এসএসকেএম হাসপাতালে। বুধবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
তিন বছর বয়স হয়ে গেল, তা-ও শিশুটি কথা বলতে পারে না। বেজায় চিন্তায় তার বাবা-মা। কিন্তু আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা বলছেন, ‘এমন হয়। ঠিকই কথা বলবে। আর একটু অপেক্ষা করো।’ কিন্তু চিকিৎসকেরা বলছেন, ‘‘একেবারেই তা নয়। কারণ, ওই শিশুটি বধিরতা নিয়েই জন্মেছে। যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা শুরু না করলে ভবিষ্যতে সে পুরোপুরি মূক ও বধির হয়ে পড়বে।’’
বুধবার, ৩ মার্চ ‘বিশ্ব শ্রবণ দিবসে’ এসএসকেএম হাসপাতালে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এমন কথাই বার বার তুলে ধরলেন চিকিৎসকেরা। তাঁরা জানাচ্ছেন, প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে অন্তত চার জনের জন্মগত ভাবে ককলিয়া বা অন্তঃকর্ণের ত্রুটি থাকে। যার ফলে ওই শিশুদের কথা ফোটে না। কান-নাক-গলার চিকিৎসকেরা বলছেন, ‘‘মানবদেহের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মধ্যে অন্যতম হল শ্রবণেন্দ্রিয়। একটি শিশু মাতৃগর্ভ থেকেই কানে শুনতে পায়। কিন্তু সেখানে ত্রুটি থাকলে বধিরতা নিয়েই ভূমিষ্ঠ হয় শিশুটি। তাই শিশুর কথা না ফুটলে তাকে কখনওই অবহেলা করা উচিত নয়।’’
এমন শিশুদের চিকিৎসার জন্যই পূর্ব ভারতে একমাত্র এসএসকেএম হাসপাতালে চালু হয়েছে ইনস্টিটিউট অব ওটোরহিনোল্যারিঙ্গোলজি, হেড অ্যান্ড নেক সার্জারি বিভাগ। এ দিনের অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিল দুই থেকে আট বছর বয়সি ৪৫ জন শিশু ও তাদের পরিজনেরা। অন্তঃকর্ণ প্রতিস্থাপনের পরে আজ ওই সব শিশু শুধু যে শুনতেই পাচ্ছে তা নয়, রীতিমতো মুখে কথাও ফুটেছে তাদের। আর তাই ‘আতা গাছে তোতাপাখি’ কিংবা ‘আকাশ আমায় শিক্ষা দিল উদার হতে ভাই রে’ আবৃত্তি করে শোনাল স্বপ্নানিকা বারিক, প্রত্যুষা ভৌমিকেরা।
সন্তানদের মুখে কবিতা শুনে চোখের জল বাঁধ মানল না অনেক বাবা-মায়ের। কেউ বললেন, ‘‘একরত্তি মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে থাকত, কিছু বলতে পারত না। কখনও ভাবিনি, ও কবিতা বলতে পারবে।’’ ইনস্টিটিউট অব ওটোরহিনোল্যারিঙ্গোলজি, হেড অ্যান্ড নেক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ইতিমধ্যেই সেখানে ৬৭টি শিশুর অন্তঃকর্ণের প্রতিস্থাপন হয়েছে। তালিকায় থাকা আরও ৫০ জনের অন্তঃকর্ণ প্রতিস্থাপন করা হবে। ‘অ্যাসিস্ট্যান্স টু ডিজ়েবলড পার্সনস ফর পারচেজ়িং’ প্রকল্পের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য, শিক্ষক-চিকিৎসক অরুণাভ সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘অন্তঃকর্ণ প্রতিস্থাপন করতে বাইরে খরচ হয় প্রায় ১৪-১৫ লক্ষ টাকা। সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর সহযোগিতায় এসএসকেএম হাসপাতালে বিনামূল্যে অন্তঃকর্ণ প্রতিস্থাপন করে আমরা অনেক শিশুকে সুস্থ জীবনে ফেরাতে পারছি।’’
স্বপ্নানিকা, প্রত্যুষার কবিতা শুনে অরুণাভবাবু বলেন, ‘‘যে খুদেরা কথা বলতে পারত না, আজ তাদের মুখে হাসি ফুটেছে। টাকার মূল্যে এর বিচার হয় না।’’ চিকিৎসকেরা জানান, অন্তঃকর্ণ প্রতিস্থাপনে শিশুর শ্রবণ-ক্ষমতা ফেরানো সম্ভব। সাধারণত বাইরের শব্দতরঙ্গ কানের মধ্যে দিয়ে মস্তিষ্কে গিয়ে সেখানে শ্রবণশক্তির অনুভূতি তৈরি করলে মানুষ শুনতে পায়। কিন্তু যে সব শিশুর অন্তঃকর্ণে ত্রুটি থাকে, তাদের সেটা সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করে কানের ভিতরে আধুনিক যন্ত্র বসানো হয়। সেই যন্ত্রের দ্বারা শব্দতরঙ্গ বৈদ্যুতিক শক্তিতে পরিবর্তিত হয়ে কানের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছে শ্রবণশক্তির অনুভূতি তৈরি করে।
অনুষ্ঠানে চিকিৎসকেরা জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ৯ কোটি মানুষ বধিরতায় আক্রান্ত হবেন। তাই জন্মের পরেই শিশুর কানের পরীক্ষা করানো একান্ত প্রয়োজন। চিকিৎসক অরিন্দম দাস বলেন, ‘‘এক বছর বয়সের পর থেকেই শিশুর অন্তঃকর্ণ প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। অস্ত্রোপচারের পরে এক-দেড় বছর শিশুর স্পিচ থেরাপি করা হলে সে কথাও বলতে পারবে। পিজিতে সেই থেরাপিও চালু হয়েছে।’’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগম, এসএসকেএমের অধিকর্তা মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায়, ইনস্টিটিউট অব ওটোরহিনোল্যারিঙ্গোলজির বিভাগীয় প্রধান দেবাশিস বর্মণ প্রমুখ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় সকলেই এ দিন সমাজের কাছে আবেদন রাখলেন, প্রতিটি শিশু যেন বলতে পারে, ‘আমি কান পেতে রই’।