গার্ডেনরিচে মৃত শিশুর বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছে অভিযুক্ত চিকিৎসক অমিতাভ মণ্ডলকে (ডান দিকে)। মঙ্গলবার। নিজস্ব চিত্র
চিকিৎসক-নিগ্রহ ঠেকাতে কবে করা হবে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ? গার্ডেনরিচের ঘটনার প্রেক্ষিতে আপাতত এই প্রশ্নেই সরব রাজ্যের চিকিৎসক
মহলের একাংশ।
ভুল চিকিৎসায় শিশু-মৃত্যুর অভিযোগ ঘিরে মঙ্গলবার তপ্ত হয়ে ওঠে গার্ডেনরিচ থানা এলাকা। চিকিৎসকদের একাংশের বক্তব্য, চিকিৎসায় গাফিলতি হয়েছে কি না তা প্রমাণসাপেক্ষ। কিন্তু যে ভাবে অভিযুক্ত চিকিৎসক অমিতাভ মণ্ডলকে তাঁর বাড়ি থেকে তুলে এনে মৃত শিশুর বাড়িতে আটকে রাখা হল, তা অত্যন্ত ‘দুর্ভাগ্যজনক’।
অবিলম্বে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি আটকাতে প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে কড়া বার্তা দেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন তাঁরা। বস্তুত তাঁদের মতে, যত জন চিকিৎসক নিগৃহীত হয়েছেন, তার তুলনায় নিগ্রহে অভিযুক্তদের শাস্তি হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। গত কয়েক বছরে চিকিৎসক-নিগ্রহে কারও ‘দৃষ্টান্তমূলক’ শাস্তি হয়নি বলেই গার্ডেনরিচের মতো ঘটনা ঘটতে পারে।
আরও পড়ুন: শিশুমৃত্যু, ডাক্তারকে বাড়িতে ডেকে মার গার্ডেনরিচে
শহরের একটি মেডিক্যাল কলেজের এক শিক্ষক-চিকিৎসক এই ঘটনায় ত্রিপুরার উদাহরণ টেনে এনেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘ওই রাজ্যে চিকিৎসক-নিগ্রহের একটি ঘটনায় সদ্য প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজে নিরাপত্তা ছেড়ে
দিতে চেয়েছিলেন।’’ আর একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজের এক চিকিৎসকের বক্তব্য, ‘‘প্রতিবাদের ভাষা জোরালো না হলে এমন পরিস্থিতির বদল ঘটানো অসম্ভব।’’ শহরেরই আর একটি সরকারি হাসপাতালের পদস্থ কর্তা তথা চিকিৎসক বলছেন, ‘‘এ রকম চলতে থাকলে সঙ্কটজনক রোগীকে আর কোনও চিকিৎসকই দেখতে চাইবেন না।’’
গার্ডেনরিচের ঘটনার নিন্দা করে পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে আরও আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছেন বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। তাঁদের বক্তব্য, নিরাপদ পরিবেশ ছাড়া চিকিৎসকেরা কী ভাবে কাজ করবেন? চিকিৎসা নিয়ে রোগীর পরিবারের অভিযোগ থাকতেই পারে। কিন্তু, আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে কেন? ডাক্তারদের বক্তব্য, ‘‘এ ধরনের পরিস্থিতির কথা ভেবে আমাদের বাড়ির লোকজন আতঙ্কে থাকেন। গত তিন বছরে বহু চিকিৎসক এই রাজ্য ছেড়ে চলে গিয়েছেন।’’ সেই সূত্রে সাম্প্রতিক কালের আরও একটি ঘটনার কথা স্মরণ করেছেন তাঁরা। এ বছরের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কয়েক জন কৃতী জানিয়েছিলেন, তাঁরা ভবিষ্যতে চিকিৎসক হতে চান। সেই মন্তব্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেন চিকিৎসকদের একাংশ। অন্য একটি অংশের বক্তব্য, পরপর নিগ্রহের ঘটনা চিকিৎসকদের মধ্যে কী প্রভাব ফেলেছে, এই বিদ্রুপ থেকেই স্পষ্ট।
চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠন যে ভাবে নিগ্রহের প্রতিবাদ জানিয়েছে, তার মধ্যেও স্পষ্ট এই ক্ষোভের প্রতিফলন। ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেল্থ সার্ভিস ডক্টর্স’-এর সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটা বলেন, ‘‘চিকিৎসকদের তরফে যে ভুল হয় না, তা নয়। কিন্তু ভুল হলেই ডাক্তার পেটানোর যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, তার প্রতিবাদ করছি। চিকিৎসককে মারধর করলে সাজা হচ্ছে, এমন নজির তৈরি হলে এ ধরনের ঘটনা কমে। কিন্তু তা তো হচ্ছে না।’’ ‘সার্ভিস ডক্টর্স ফোরাম’-এর সাধারণ সম্পাদক সজল বিশ্বাস বলেন, ‘‘আইনশৃঙ্খলার ঊর্ধ্বে রোগীর পরিজনেরা কত প্রভাবশালী, তা জাহির করার একটা প্রবণতা অনেক দিন ধরেই তৈরি হয়েছে। এখন তা দুঃসাহসে পরিণত হয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এর প্রভাব পড়বে।’’ এক ধাপ এগিয়ে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম’ (ডব্লিউবিডিএফ)-এর সম্পাদক কৌশিক চাকী বলছেন, ‘‘গার্ডেনরিচে যা হয়েছে, তা গত আড়াই বছরের নৈরাজ্য এবং প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার পরিচয়।’’
এ দিন গার্ডেনরিচের ঘটনার পরে ডব্লিউবিডিএফের তরফে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পাঠানো স্মারকলিপিতেও ‘কড়া বার্তা’র অভাবের কথা তুলে ধরা হয়েছে। গোটা বিষয়টি নিয়ে চিকিৎসক-প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানিয়েছে ওই সংগঠন।
ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (আইএমএ) সর্বভারতীয় সভাপতি তথা তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ শান্তনু সেনের বক্তব্য, ‘‘গার্ডেনরিচের ঘটনা জানা মাত্র পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে বলেছি। পশ্চিমবঙ্গে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলির উপরে হামলা রোধে আইন রয়েছে। সেই আইন পুলিশ ঠিক মতো প্রয়োগ করলে এ ধরনের ঘটনা কমবে। তবে সারা দেশেই চিকিৎসকেরা নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। তাই বহু দিন ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সর্বভারতীয় স্তরে এ ধরনের হিংসা রোধে আইন তৈরির জন্য আর্জি জানিয়ে আসছে আইএমএ।’’