ফাইল চিত্র
সংক্রমণ রুখতে বাজারে একাধিক প্রতিষেধকের পাশাপাশি হাজির একরাশ প্রশ্নও। যা অনেককে এখনও বিভ্রান্ত করছে। কোন প্রতিষেধক বেশি কার্যকর? ভাইরাস যদি চরিত্র ও বিন্যাস বদলায়, তখন প্রতিষেধক কতটা প্রতিরোধ করবে? ওষুধ কি আদৌ আসবে? এমন আরও। নিশ্চিত উত্তর এখনও অজানা। করোনাভাইরাসকে নিয়ে কী ভাবে কাজ চলছে, সেই ধারণা দিতে এই আলোচনা।
প্রতিষেধক শরীরে ঢুকে সাধারণত তিন রকম ভাবে কাজ করে।একটি পদ্ধতিতে ভাইরাস বা ব্যাক্টিরিয়াকে বহু গুণ দুর্বল করিয়ে প্রতিষেধকের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করানো হয়। ভাইরাস দুর্বল হওয়ায় শরীরে বড় ক্ষতি হয় না, বরং সৈন্যের মতো কাজ করে। তবে ভাইরাস বা ব্যাক্টিরিয়াভিত্তিক এই প্রতিষেধক থেকে রিভার্সন বা সংক্রমণের প্রত্যাবর্তনের আশঙ্কা থাকে।
সেই জন্য করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যে পদ্ধতির প্রতিষেধক বেশি প্রচলিত, তা হল এমআরএনএ (mRNA) ভিত্তিক। করোনাভাইরাস সংক্রমণের জন্য দায়ী যে স্পাইক প্রোটিন, তার সৃষ্টিকর্তা এমআরএনএ-কে শরীরে প্রতিষেধকের মাধ্যমে ঢোকানো হয়। ফলে ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিজেনিক রেসপন্স, অর্থাৎ বিরাট সেনা আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে অসুবিধা হয় না। এই পদ্ধতিতে ভাইরাস অথবা ব্যাক্টিরিয়াভিত্তিক প্রতিষেধকের মতো রিভার্সনের আশঙ্কাও থাকে না। এ ক্ষেত্রে ভাইরাল প্রোটিনকে ব্যবহার করে যুদ্ধ শুরু হয়। এই ধরনের প্রতিষেধক মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কম তাপমাত্রায় না রাখলে দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।
এর পরেই তালিকায় রয়েছে টি-সেল ভিত্তিক প্রতিষেধক। টি-সেল সেই সৈনিক সম্প্রদায়, যারা ভাইরাল বা ব্যাক্টিরিয়াল প্রোটিনের বিরুদ্ধে প্রচুর অ্যান্টিবডি তৈরি করে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী সারা গিলবার্ট এই প্রতিষেধক তৈরি করেন। যা অত্যন্ত কার্যকর, তবে সামান্য হলেও এতে রিভার্সনের আশঙ্কা থাকে।
কিন্তু প্রতিষেধকের এই রকমফের না জেনে মানুষ তার কার্যকারিতা নিয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। অথচ কার্যকারিতা নির্ভর করে অনেকগুলো বিষয়ের উপরে। যার একটি হল, জিনের গঠন তারতম্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর উপরে প্রতিষেধক আলাদা প্রভাব ফেলে। যেমন, ককেশীয় জনগোষ্ঠীর জিনগত চরিত্রের সঙ্গে তফাত রয়েছে এশীয় জনসমষ্টির। অতএব মডার্না, ফাইজ়ার বা জনসন অ্যান্ড জনসন প্রতিষেধকের কার্যকারিতা জনসমষ্টির পরিবর্তনের সঙ্গেই বদলাবে। ফলে অমুক প্রতিষেধক ৯০-৯৫ শতাংশ কার্যকর, এমনটা বলা পুরো ঠিক না।
এ বার প্রশ্ন, প্রতিষেধক কি কোভিড সংক্রমণ থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেবে? সহজ উত্তর, সংক্রমণ থেকে মুক্তি না দিলেও মৃত্যু থেকে অনেকটাই পরিত্রাণ দেবে। তার কারণ, শরীরের ভিতরে ভাইরাল স্পাইক প্রোটিনের বিরুদ্ধে বিপুল অ্যান্টিবডি রেসপন্স তৈরি করে প্রতিষেধক। এই অ্যান্টিবডি রেসপন্স স্পাইক প্রোটিনগুলিকে হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের রক্তজালির উপরে বসতি করতে দেয় না। ফলে মৃত্যু আটকে দিতে যথেষ্ট সক্ষম।
এই প্রতিষেধক তৈরিতে আধুনিক কম্পিউটারের অবদান না বললেই নয়। কোভিড ১৯ ভাইরাসের চরিত্র বুঝতে তার কাঠামোগত বিন্যাস বোঝা জরুরি। তা বুঝতেই বিজ্ঞানীরা আধুনিক কম্পিউটারের সাহায্যে ভাইরাসের জিনগত মানচিত্র তৈরি করেন। যা থেকে বোঝা যায়, বিশেষ স্পাইক প্রোটিন ফুসফুস বা হৃৎপিণ্ডের কোষে বসে আক্রমণ হানছে। এই ভাইরাসের অতর্কিত আক্রমণে কখনও শরীরে ‘সাইটোকাইন স্টর্ম’ শুরু হয়। যা ধীরে ধীরে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বিকল করে দেয়। ভাইরাস যখন বিভিন্ন কোষে গেড়ে বসে, তখন সেই অবস্থানকে মডেল করে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর সাহায্য নিয়ে চিকিৎসার নির্দিষ্ট পদ্ধতি তৈরি হয়।কী ভাবে চলছে ওষুধ তৈরির প্রক্রিয়া?
কোষে কোনও প্রোটিনের বিশেষ অবস্থানকে বৈজ্ঞানিক সঙ্কেতে রিসেপটর লিগান্ড ইন্টার্যাকশন বলে। কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর মাধ্যমে ওই বিশেষ অবস্থানকে মডেল করা যায়। কিছু অবস্থান রাসায়নিক ভাবে স্থিতিশীল, কিছু আবার ক্ষণস্থায়ী। এদেরকে অ্যাগনিস্ট এবং অ্যান্টাগনিস্ট ড্রাগ পরমাণু দিয়ে প্রতিরোধ করা যায়। অ্যাগনিস্ট সেই ড্রাগ পরমাণু, যা প্রোটিনের বিশেষ অবস্থানকে প্রতিক্রিয়াশীল করে তোলে। অ্যান্টাগনিস্ট, প্রোটিনের বিশেষ অবস্থানকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে এ সব থেকেই গণনা করা যায়, কোনটি ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর। করোনার সঙ্গে যুদ্ধে যে নতুন নতুন অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ ব্যবহার হয়, তার শক্তি মালুম হয় এই কম্পিউটার মডেলের মাধ্যমে। করোনাভাইরাসের ওষুধ তৈরির পরীক্ষা-নিরীক্ষার অধিকাংশ, এই পথেই হচ্ছে। কার্যকর ওষুধ তৈরি হলেই, মিলবে বহু উত্তর। তার আগে পর্যন্ত শত্রুকে সমীহ করে নিয়ম মেনে চলা ছাড়া উপায় নেই।