কেন্দ্র: এই পার্কেই বসবে গল্পের আসর। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
ইস্টবেঙ্গলের বিখ্যাত পাঁচ ফরোয়ার্ড বা ‘পঞ্চপাণ্ডব’দের দু’জন আপ্পারাও এবং সালেকে নিয়ে একটি গল্প মুখে মুখে ফেরে।
কলকাতায় চল্লিশের দশক শেষের উত্তাল দিনগুলিতে কলুটোলার একটি ডেরায় হানা দিয়েছিল দুর্বৃত্তের দল! আপ্পারাওকে খাটের তলায় লুকোতে বলে তখন পরিস্থিতি সামাল দেন সালে। শান্ত ভাবে বুঝিয়ে বলেন, ঘরে ভিন্ধর্মী কেউ নেই। খানিক সংশয় থাকলেও রণে ভঙ্গ দেয় হামলাবাজেরা। রুদ্ধশ্বাস কিছু মুহূর্তের পরে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে লুকিয়ে থাকা আপ্পারাওয়ের। পরে ফুটবলারদের অন্যত্র সরান ক্লাবকর্তারা। শোনা যায়, এর আগে সালেকে মোটেও পছন্দ করতেন না আপ্পারাও। কিন্তু বিপদে পাশে থাকার সেই ঘটনার পরে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়।
শহর কলকাতার রক্তে আবহমান কাল থেকেই রয়েছে পরস্পরের হাত ধরে বাঁচার মন্ত্র। ভিন্ রাজ্যে মন্দির-মসজিদ নিয়ে মন কষাকষিই শেষ কথা বলে না। বিপদের সময়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পরস্পরের পাশে দাঁড়ানোর নজির ভূরি ভূরি। কলকাতা পুরসভার পুরনো গেজেট বইয়েও তা ঠাঁই পেয়েছে। দেশে বহুত্বের ধারণা নিয়ে কাঁটাছেঁড়ার দুর্দিনে সে সব স্মৃতির উত্তাপে সেঁক নিতে চান সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী এই শহরের নাগরিকেরা। চলতি মাসের শেষে ২৯ ও ৩০ নভেম্বর খিদিরপুরে ‘ডাইভার্সিটি ফেস্টিভাল’ বলে একটি উৎসবের মঞ্চ এই দিকগুলি মেলে ধরবে।
অনুষ্ঠানটির অন্যতম আহ্বায়ক সমাজকর্মী সাবির আহমেদ বলছিলেন, ‘‘হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক থেকে শুরু করে নানা ভাবেই দেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ফাটল খুঁচিয়ে তোলা চলছে। ইতিহাসের পুরনো সংঘাত উস্কে দিয়েও বিভেদ বাড়ানো হচ্ছে। সম্প্রীতির ঘটনাগুলিরও তাই প্রচার দরকার। প্রবীণ নাগরিক থেকে ইতিহাসবিদ, সবার কাছেই এই ধরনের অভিজ্ঞতার খোঁজে আমরা হাত পাতছি।’’ শুধু দু’দিনের উৎসব নয়, এই বিষয়গুলির চর্চা বছরভর চালাতে তাঁরা ইচ্ছুক। বছর দুয়েক আগের ইদের সময়েও অনেকটা একই ভাবে মুসলিমদের নিয়ে কিছু বাঁধা গতের ধ্যান-ধারণা ভাঙতে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারযোগ্য ছোট-ছোট নাটিকার সাহায্য নিয়েছিলেন তাঁরা। অনেকটা সেই ভাবেই ইতিবাচক ঘটনাগুলি মেলে ধরতে চান সাবিরেরা।
কলকাতা পুরসভার গেজেটে রয়েছে, ১৯৪৬-’৪৭ সালে লিন্টন স্ট্রিটের বি এন ঘোষ বা উত্তর কলকাতার বিডন রোয়ের আব্দুল হামিদ, আব্দুর রউফদের পুরনো গল্প। ঘোষবাবু জানিয়েছেন, বাইরে থেকে আসা দুর্বৃত্তদের সামনে মুসলিম পড়শিরা কী ভাবে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। হিন্দু অধ্যুষিত মহল্লায় হামিদ সাহেবদের আবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নীলমণি মিত্র স্ট্রিটের আশ্রয়ে নিয়ে যান সহৃদয় পড়শিরাই। মোমিনপুরের হুসেন শাহ পার্কের যে মাঠে এ সব গল্প উঠে আসবে, ঘটনাচক্রে সেখানেই বছরভর দুর্গা, কালী, সরস্বতী পুজো এবং দু’টি ইদের নমাজের জমায়েত বসে।
এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক তথা ইতিহাসবিদ কুণাল চট্টোপাধ্যায়। কুণালের পরিবারও তিন পুরুষ ধরে বালিগঞ্জের কাছে পাম প্লেসের বাসিন্দা। খুব কাছেই মুসলিম অধ্যুষিত মহল্লা। তিনি বলছিলেন, ‘‘বাবার কাছে শুনেছি, দেশভাগের সময়কার গোলমালে বাইরে থেকে কেউ হামলা করতে পারে বলে মুসলিম প্রতিবেশীদের হাতে বাড়ির চাবি দিয়ে আমরা অন্যত্র সরে যাই। শান্তি ফিরলে দিব্যি ফিরে এসে বাবারা দেখেন, ওঁরা আমাদের সব কিছু আগলে রেখেছেন।’’ কুণালের অভিজ্ঞতা, ‘‘কয়েক বছর ধরে হিন্দু ও মুসলিমদের স্রেফ বিবদমান দু’টি শত্রু গোছের গোষ্ঠী বলেই কেউ কেউ দেখাতে চাইছেন। ভুল ধারণাগুলি অজ্ঞতার ফলেই দানা বাঁধছে।’’
বহুত্বের উৎসবের আয়োজকেরা বছরভর ‘নো ইয়র নেবার’-আহ্বানের মোড়কে কলকাতার নানা পাঁচমিশেলি পাড়ার সংস্কৃতি মেলে ধরেন। খিদিরপুরের এই উৎসবে এগিয়ে এসেছেন স্থানীয় গভর্নমেন্ট গার্লস জেনারেল ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষা সৈয়দা শরিকাতুল মৌলা আল কাদরি বা ইংরেজির শিক্ষিকা অন্তরা মুখোপাধ্যায়রা। অন্তরা বলছিলেন, ‘‘তিন বছর আগে কলেজে পড়াতে আসার আগে এই পাড়া নিয়ে নানা ভুল কথা শুনেছি। খুব কাছ থেকে ভিন্ সংস্কৃতির মানুষজন, ছাত্রী, সহকর্মীদের দেখে বুঝি, আমাদের ধারণায় কত ভুলের ছড়াছড়ি।’’ রাজনীতির টানাপড়েনের দিনকালে সেই ভুল ভাঙার কথাই বলছে কলকাতা।