আতঙ্কিত: শব্দবাজির ভয়ে খাটের নীচে লুকিয়ে পোষ্য। বৃহস্পতিবার, নিউ টাউনের একটি বাড়িতে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
বসার ঘরে সোফার নীচে ছোট্ট একটা ফাঁক। তার মধ্যেই প্রাণপণে মাথা গুঁজে লুকিয়ে আছে বছর আড়াইয়ের জিমি। বাইরে একটা-একটা করে শব্দবাজি ফাটছে, আর কেঁপে কেঁপে উঠছে সে। কুকুরের মালিক হাজার চেষ্টা করেও তাকে বার করে আনতে পারছেন না সেখান থেকে। রাতের দিকে শব্দের তাণ্ডব যত বেড়েছে, ততই যেন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গিয়েছে সে। পরে ওই জায়গা ছেড়ে কুকুরটি যখন বেরোয়, তখন দেখা যায়, আতঙ্কে বেশ কয়েক বার সেখানেই মল-মূত্র ত্যাগ করে ফেলেছে সে। প্রায় একই অবস্থা হয় শহরের বিভিন্ন এলাকার পথকুকুরদেরও।
আদালতের নির্দেশ উড়িয়ে চলতে থাকা শব্দবাজির তাণ্ডবে বৃহস্পতিবার জিমির মতোই অবস্থা হয়েছিল শহরের আরও অসংখ্য পোষ্যের। আদালত শুধুমাত্র সবুজ বাজি পোড়ানোর ছাড়পত্র দিলেও তা মানেননি অনেকেই। যে কারণে দীপাবলির সন্ধ্যা থেকেই শহর জুড়ে দেখা গেল নিষিদ্ধ বাজির তাণ্ডব। বুধবার সন্ধ্যায় যা শুরু হয়েছিল, পরদিন সন্ধ্যায় তারই মাত্রা বেড়ে গেল বহু গুণ। পরিবেশবিদ ও পশুপ্রেমীরা অবশ্য আগেই এমন আশঙ্কা করেছিলেন।
শব্দবাজির তাণ্ডব থেকে প্রিয় পোষ্যকে বাঁচাতে কেউ কেউ আবার শরণাপন্ন হয়েছিলেন পশু চিকিৎসকের। সুকিয়া স্ট্রিটের বাসিন্দা সুপ্রিয় বসাক বললেন, ‘‘বুধবার রাতে অল্প যে কয়েকটা বাজি ফেটেছে, তাতেই ভয়ে খাটের তলায় লুকিয়ে ছিল আমাদের রানি। ভয়ে চোখ দিয়ে জল ঝরছিল সমানে। দীপাবলির রাতে কী হবে, সেই আশঙ্কায় ডাক্তারের কাছে ছুটলাম। কিন্তু তিনিও এর থেকে মুক্তির কোনও পথ দেখাতে পারলেন না।’’ গড়িয়ার বাসিন্দা দিব্যেন্দু গোস্বামীর কথায়, ‘‘শব্দবাজির ভয় তো ছিলই, পাড়ায় বাজতে থাকা তাসার আওয়াজেও আমাদের পোষ্য কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ওকে জড়িয়ে ধরে বসে থেকেই আমাদের স্বামী-স্ত্রীর কালীপুজোগুলো কাটে। এ বার আদালতের নির্দেশের পরে একটু আশায় ছিলাম। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম, কিছুই পাল্টায়নি।’’ দু’দিন আগেই বাজির বিরুদ্ধে পোষ্যদের মিছিলে অংশ নেওয়া পাটুলির সন্দেশকে আবার রাখতে হয়েছিল গান চালিয়ে। সন্ধ্যায় বাজি ফাটা শুরু হতেই ঘরের ভিতরে ছুটতে শুরু করে সে। কিছুতেই তাকে শান্ত করা যাচ্ছিল না। চিকিৎসকের পরামর্শে বাইরের শব্দ ঠেকাতে জোরে গান চালানোর ব্যবস্থা করেন ওর অভিভাবকেরা।
পশু চিকিৎসক অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, যে কোনও পোষ্যেরই শ্রবণশক্তি মানুষের শ্রবণশক্তির চেয়ে অনেকটা বেশি হয়। তাই বাজির আওয়াজ মানুষের থেকেও কয়েক গুণ বেশি জোরে শুনতে পায় ওরা। যার প্রভাব সাত-আট দিন পর্যন্তও থাকতে পারে। আতঙ্কে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিতে পারে পোষ্যেরা। অভিরূপবাবুর কথায়, ‘‘তবু মানুষ ওদের যন্ত্রণা বোঝে না।’’
পশু চিকিৎসক দীপককুমার দে জানাচ্ছেৈৈন, বাজিই হোক বা সাউন্ড বক্স, শব্দের তাণ্ডবে বাড়ির পোষ্যদের পাশাপাশি সমস্যায় পড়ে পথকুকুরেরাও। তাঁর কথায়, ‘‘শব্দের দাপট যেখানে বেশি, সেই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার চেষ্টা করে পথকুকুরেরা। এর ফলে এলাকার দখল নিয়ে মারামারিতে কুকুরের প্রাণও যেতে পারে। এ ছাড়া বাজির শব্দে ভয় পেয়ে কুুুকুরেরা অজ্ঞানও হয়ে যায় অনেক সময়ে। এ নিয়ে পরিবেশপ্রেমী ও পশুপ্রেমীরা বহু দিন ধরে সরব হলেও কাজের কাজ কিছু হয় না।’’
বেলেঘাটা পশু হাসপাতালে মৃত পোষ্যের সমাধির সামনে শ্রদ্ধা জানাতে হাজির, উল্টোডাঙার ত্রিময়ী গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, ‘‘এমন এক কালীপুজোর রাতেই বাজির শব্দে ভয় পেয়ে ছুটতে গিয়ে খাট থেকে বেরিয়ে থাকা চাবি চোখে ঢুকে যাওয়ায় দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল আমাদের আদরের শম্ভু। ওই ঘটনার পরে মাত্র ছ’মাস বেঁচে ছিল। ওর যন্ত্রণার কথা মনে পড়লে আর উৎসব পালন করতে ইচ্ছে হয় না।’’