বাবা কথা দিয়েছিলেন এ বার পুজোয় মহুলকে নিয়ে রাজস্থান বেড়াতে যাবেন। কাজের চাপে যথারীতি তিনি কথা রাখতে পারেননি। তা বলে কি মহুলের বেড়ানোর সাধ অপূর্ণই থেকে যাবে? কিন্তু এই উৎসবের শহরে মা ফেরান না কাউকেই। তাই এ বার পুজোয় কলকাতাতেই হবে ভারতভ্রমণ।
এলাচি রামচন্দ্রপুর মিলন সঙ্ঘের পুজোয় উঠে এসেছে রাজস্থান। মণ্ডপে ঢোকার মুখে থাকবে বালি দিয়ে সাজানো নকল মরুভূমি। এখানে দেবী রাজস্থানি ঘরানার ঘাঘরা-চোলি পরিহিতা। রাজস্থানি চিত্রকলা, কাঠপুতুল, রঙিন কাপড়ে মণ্ডপ সাজাচ্ছে ঠাকুরপুকুরের স্টেট ব্যাঙ্ক পার্ক সর্বজনীনও। রাজস্থানি শিল্পের সঙ্গে মিশবে বাংলার শিল্পকাজ।
শুধু রাজস্থানই বা কেন, মহুলের মতো যাদের এখনও অদেখা রয়ে গেছে অনেক জায়গা, তারা এ বার এক ঝলকে ঘুরে নিতে পারে ওড়িশা থেকে বিষ্ণুপুরও। ওড়িশার পটচিত্র, গ্রামীণ আদিবাসীদের তৈরি চিত্র, পিপলি, অ্যাপ্লিক, জরি ও জগন্নাথের ছাতায় সাজবে চারু অ্যাভিনিউয়ের নবপল্লি সঙ্ঘ সর্বজনীনের মণ্ডপ। এখানে প্রতিমা জগন্নাথদেবের মূর্তির আদলে। রথের আদলে তৈরি বেহালা ত্রিশক্তি সঙ্ঘের পুজো মণ্ডপও। মণ্ডপ জুড়ে আঁকা থাকবে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের কথা। প্রতিমা এখানে সাবেক।
বেহালা সম্মিলিত জয়রামপুর সর্বজনীনের পুজোয় থাকবে বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুরের টেরাকোটার কাজ। মণ্ডপ মল্ল রাজার আমলের মূর্তি ও মন্দির দ্বারা প্রভাবিত। বিষ্ণুপুরের মন্দিরের আদলে তৈরি হচ্ছে যাদবপুর নর্থ রোড সর্বজনীনের মণ্ডপও।
৫০তম বর্ষে রামলালবাজার ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের মণ্ডপ হচ্ছে বৌদ্ধমঠের আদলে। আলতা, সিঁদুর, শাখা, পলা ব্যবহার হচ্ছে মণ্ডপসজ্জায়। এই পুজোর আয়োজক ক্লাবেরই প্রায় ২২-২৫ জন মহিলা সদস্য।
সিকিমের নামচির কাছে ‘চারধাম’-এর বিখ্যাত শিবমন্দির সিদ্ধেশ্বরভারাধামের আদলে বানানো হয়েছে বাটানগর নিউল্যান্ডের পুজো মণ্ডপ। ৮০ ফুট উঁচু মণ্ডপে থাকবে ৪০ ফুট উচ্চতার শিবমূর্তি। সঙ্গে থাকছে কৃত্রিম ঝর্না, সঙ্গে ৮৫ কেজি ওজনের একটি ঘণ্টাও। মা এখানে ‘রণং দেহি’ রূপে আবির্ভূতা।
মহুলের ছোট্ট জীবন জুড়ে আছে রাশি রাশি গল্পকথাও। সেই সমস্ত গল্পও এ বার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মণ্ডপের আনাচে-কানাচে। নির্ভীক সঙ্ঘের ৪৪তম বর্ষের পুজোয় ৪৪টি চিত্রে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পুরাকালের কাহিনি। রম্ভাসুর ও কারম্ভাসুর থেকে দেবী চণ্ডীর হাতে অসুর বধ সবেরই দেখা মিলবে। লেকটাউন অধিবাসীবৃন্দের ভাবনা ‘দারুকারুতে রামায়ণকথা’। থাকছে প্লাইয়ে আঁকা রামায়ণের পটচিত্র।
কাঁকুড়গাছি স্বপ্নার বাগান যুবকবৃন্দের ভাবনা ‘সৃষ্টি, স্থিতি, লয়’। পুরাণের গল্প অনুসারে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র বা মহেশ্বর এই তিন গ্রন্থির মাধ্যমে দেখানো হয়েছে দশপ্রহরণধারিনী মা ও ‘সৃষ্টি, স্থিতি, লয়’-এর রহস্য। দেবী এখানে লালনময়ী রূপে। আবার দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের গল্প বলতে বেলেঘাটা নবজাগ্রত সঙ্ঘের প্রতিমা তেজস্বিনী, ‘রুদ্রাণী’। মেটালিক রঙে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দেবীর রুদ্রময়ী রূপ।
পুজো উদ্যোক্তারা বিভিন্ন বার্তা পৌঁছে দিতে বেছে নিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন মৌলিক ভাবনাও। বার্ধক্যে যেন কোনও মায়ের স্থান বৃদ্ধাশ্রমে না হয়, এই বার্তা পৌঁছে দিতে পানিহাটি শহিদ কলোনির ৬৫ বছরের পুজোর প্রতিমা মাতৃরূপে প্রতিভাত। এখানে দুর্গা গণেশজননী। বিভিন্ন রকম গাছের নানা অংশ দিয়ে সাজছে মণ্ডপ।
আবার ভালুকা, জ্যাওঠা, মাকলা- এই তিন ধরনের বাঁশে সাজানো হচ্ছে কোলাহল গোষ্ঠীর মণ্ডপ। অসম, ত্রিপুরা, দিনাজপুরের শিল্পীরা বাঁশের শিল্পকলায় উদীয়মান সূর্যের আদলে মণ্ডপ গড়েছেন।
ছোট্ট একটি বাক্সে মহুল জমিয়েছিল কুড়িয়ে পাওয়া হরেক জিনিস, যার কদর শুধু সে-ই জানে। তেমনই ফেলে দেওয়া দশ রকম ফলের দানা দিয়ে তৈরি হচ্ছে পূর্ব পুটিয়ারি প্রগতি সঙ্ঘের পুজো মণ্ডপ। ৫৬তম বর্ষে নীলগঞ্জ রোড সর্বজনীনের পুজোমণ্ডপ সাজছে ঝিনুকে। প্রতিমা সাবেক। সন্তোষপুর ত্রিকোণ পার্কের ভাবনা ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু’। ভাবনার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে সেলোটেপ দিয়ে সাজানো হচ্ছে মণ্ডপ।
এ শহর আর মনখারাপিয়া নয়। মহুল জানে উৎসবের শহরের অলিতে গলিতে সে ঠিকই খুঁজে পাবে স্বপ্নের উড়ান, ছোট্ট জীবনে জমিয়ে রাখা হরেকরকম নুড়ি-পাথর।