কোনওক্রমে বাসে ওঠার চেষ্টা। সোমবার, বাগুইআটিতে। নিজস্ব চিত্র
আশা জুগিয়েছিল মে মাসের পরিসংখ্যান। জুনে সেই পরিসংখ্যানই ক্রমে স্নায়ুর উপরে চাপ তৈরি করছে কলকাতায়। স্বাস্থ্য দফতরের বুলেটিন অনুযায়ী, মে মাসে শহরে প্রতিদিন গড়ে ৫০ জনের দেহে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব মিলেছিল। গত দু’সপ্তাহে সেই গড় বেড়ে হয়েছে দেড়শোর কাছাকাছি।
কলকাতায় দিন-পিছু আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমপান এবং লকডাউন শিথিল হওয়ার ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, গত ২০ মে ঘূর্ণিঝড়ের পরে বিদ্যুৎ ও জলের সঙ্কটের জেরে অনেক জায়গায় দূরত্ব-বিধি মানা সম্ভব হয়নি। ঝড়ের দু’সপ্তাহ পরেই, গত ২ জুন শহরে এক দিনে আক্রান্তের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যায় (১১৬ জন)। ঘটনাচক্রে, ওই সময়েই সরকারি-বেসরকারি অফিস খোলার পাশাপাশি চালু হয় গণপরিবহণও। স্বাস্থ্য দফতরের বুলেটিন অনুযায়ী, ২ জুন থেকে ১২ জুন পর্যন্ত গড়ে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১০০। ১৩ জুন থেকে ২৮ জুনের মধ্যে সেই গড় হল ১৪০ জন।
সার্বিক ছবিতেও আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতাই ধরা পড়েছে। ৪ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত যেখানে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৪৮৪ জন, ১ জুন থেকে ২৯ জুন পর্যন্ত সেখানে সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছে ৩৬২৭ জন। জুনের পরিসংখ্যান পৃথক ভাবে বিশ্লেষণ করলে বৃদ্ধির সূচক আরও স্পষ্ট হবে বলে মত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। স্বাস্থ্য দফতরের তথ্যই বলছে, ১ জুন থেকে ১৪ জুন কলকাতায় আক্রান্ত হন ১৫৪৬ জন। পরবর্তী দু’সপ্তাহে (১৫-২৯ জুন) ২০৮১ জনের সংক্রমণ ধরা পড়ে।
বাড়ছে সংক্রমণ
• মে মাস: ১৪৮৪ জন
• জুন মাস: ৩৬২৭ জন
১-১৪ জুন: ১৫৪৬ জন
১৫-২৯ জুন: ২০৮১ জন
পুরসভা সূত্রের খবর, ৮ এবং ৯ নম্বর বরোয় সংক্রমণের হার উদ্বেগজনক। ৩, ৪, ১০ এবং ১২ নম্বর বরোয় আক্রান্তের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী। ৭ নম্বর বরোয় সংখ্যা কমলেও, সন্তুষ্টির জায়গা নেই। কোভিড নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যুক্ত পুরসভার এক চিকিৎসক-আধিকারিক জানান, ভাইরাসের হানা বলতে যা বোঝায়, তা প্রথম হয়েছিল উত্তর কলকাতায়। সেখান থেকে মধ্য কলকাতা হয়ে দক্ষিণের বসতিপূর্ণ এলাকায় প্রবেশ করে করোনাভাইরাস। প্রথমে বস্তি এলাকায় সংক্রমণ বেশি হলেও তা রুখে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়রান্টিন নীতির সুফল মিলেছে। তাঁর কথায়, ‘‘এখন মূলত মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তেরা আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে বেশির ভাগই উপসর্গহীন বা মৃদু উপসর্গযুক্ত। তাই গৃহ-পর্যবেক্ষণে থাকার সংখ্যাও বাড়ছে।’’ তিনি জানান, রাজারহাটে পুরসভার কোয়রান্টিন কেন্দ্রে রিপোর্ট পজ়িটিভ হওয়ার হার দুই শতাংশের কম। তিনি বলেন, ‘‘আমার ব্যক্তিগত মত হল, উপসর্গহীনদের থেকে ভাইরাস বেশি ছড়াচ্ছে না। নইলে কোয়রান্টিন কেন্দ্রে রিপোর্ট পজ়িটিভ হওয়ার হার এত কম হত না।’’
আরও পড়ুন: অ্যাপ-ক্যাব চালকদের সুরক্ষার দাবিতে চিঠি
শহরের একটি বেসরকারি পরীক্ষাগারের ডিরেক্টর, চিকিৎসক অভীক বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, তাঁদের এলগিন রোড এবং নিউ টাউনের কেন্দ্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে নিজে থেকে নমুনা পরীক্ষা করাতে আসার প্রবণতা বেড়েছে। এ ধরনের নমুনা পজ়িটিভ হওয়ার হার বেশি হলেও বেশির ভাগই উপসর্গহীন বা মৃদু উপসর্গযুক্ত। পুর স্বাস্থ্য আধিকারিকদের একাংশের বক্তব্য, নমুনা পরীক্ষার হার বেড়েছে, তাই পরিসংখ্যান দেখে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কলকাতায় মৃত্যুর হার কমানোই মূল লক্ষ্য বলে মত স্বাস্থ্য আধিকারিকদের একাংশের। জুনের হিসেব বলছে, এ পর্যন্ত মোট আক্রান্তের নিরিখে কলকাতায় মৃত্যুর হার ৪.৪৯ শতাংশ।
আরও পড়ুন: মেট্রোর ভিড় কমাতে অনলাইন বোর্ডিং পাস?
রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘কলকাতার জনঘনত্ব এমনিতেই বেশি। বাইরে থেকে কাজের জন্য বহু মানুষ আসায় এই সংখ্যা দিনের বেলায় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।’’ মৃত্যু রোধে স্বাস্থ্য দফতরের লক্ষ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘কলকাতায় মৃত্যু হচ্ছে কারণ কো-মর্বিড এবং বয়স্ক লোকের সংখ্যা বেশি। সিসিইউ, অক্সিজেনের সুবিধাযুক্ত শয্যার সংখ্যা বৃদ্ধির উপরে জোর দিচ্ছি। আমরা যা দেখেছি, তাতে শুধু অক্সিজেনে কাজ হবে না। হাই-ফ্লো অক্সিজেন দেওয়া প্রয়োজন।’’