লাল-নীল: সেলিম ও সালমার সংসার। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের ফুটপাথে। নিজস্ব চিত্র
কলকাতা কি ম্যাজিক জানে?
না হলে ফুটপাথে সংসার পেতেও কেউ বলতে পারেন, ‘‘নেই বাদ দিয়ে আছে-র হিসেব করুন কত্তা! দেখবেন, সব দুঃখ হাওয়া! কী বলো সালমা?’’
এক গাল হেসে সালমা বিবি ঘোমটা টানেন। স্টিলের কৌটো করে পাশের চায়ের দোকান থেকে নিয়ে এসেছেন গরম দুধ চা। দু’জনের জন্য। কিন্তু আগন্তুক দেখে সালমা নাছোড়বান্দা, ‘‘আপনারা মেহমান। খেতেই হবে!’’
অগত্যা দু’কাপ চা ভাগাভাগি করে চার জন। শীতের বেলা দ্রুত গড়ায়। মেডিক্যাল কলেজের উল্টো দিকের ফুটপাথে তখনও লোকজনের অবিরাম যাতায়াত। অথচ ভিক্ষের বাটিতে প্রাপ্তি তলানিতে!
বৃদ্ধ কাশতে শুরু করেন। সালমারও সম্বিত ফেরে, ‘‘কই, একটু পানি খাও দিকি।’’ হাত কাঁপে সেলিমের। কিছুটা জল গড়িয়ে পড়ে আদুল গায়ে। অথচ মুখে হাসি, ‘‘ডাক্তার বলেন স্নায়ুর রোগ। সেরে যাবে। সত্যিটা কিন্তু আমি জানি!’’ সেই রোগ নিয়েই জঙ্গলপুর থেকে দু’জনে এসেছিলেন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তার পরে পিজি। কিন্তু কাঁহাতক আর চরকি পাক ঘোরা যায়! অতএব, পিজির সামনেই আস্তানা গাড়া। রোজগার বন্ধ। খাওয়ার টাকা নেই, ওষুধ নেই, জঙ্গলপুরে বকেয়া ঘর ভাড়া। ‘‘তবে পিজির সামনে বড্ড ঝামেলা। তাই বছর তিনেক আগে মেডিক্যালের সামনে ফিরে আসি’’— বললেন সেলিম। দম্পতি জানালেন, সারা দিনে বাটিতে জমা হয় আশি থেকে একশো টাকা। পুজো-পার্বণে টাকার অঙ্কটা একটু বাড়ে। সেই টাকাতেই মাসে এক বার পিজিতে যাতায়াত। সেলিম বাসে উঠতে পারেন না। তাই ট্যাক্সি। ফের হেসে ওঠেন সেলিম, ‘‘মাসে এক দিন ট্যাক্সিতে উঠলেই রোগ নয়, মনে পড়ে বিয়ের পরের দিনগুলোর কথা। সালমাকে শহর দেখানোর কথা।’’
আরও পড়ুন: ‘যৌন নিগ্রহ তো বলা হয়নি’, বললেন শিশুটির চিকিৎসক
দিন কয়েক আগে এক ব্যবসায়ীর সহযোগিতায় কিনে ফেলেছেন একটি ট্রাইসাইকেল। বাটিতে তেমন কিছু না পড়লে দু’জনেই বেরিয়ে পড়েন চেনা শহরে। কিছু টাকা ঠিকই জুটে যায়। আচমকা হাজির আরও এক অতিথি। সেলিম শেখ এ বার তাড়া দেন, ‘‘এখন না, রাতে আসিস। তোর জন্যও এক মুঠো ভাত রেখে দেব।’’ লেজ নেড়ে চলে গেল বাধ্য সারমেয়।
কোথায় কোথায় যে পথ পৌঁছয়, নিজেদের জীবন দিয়ে দেখছেন সালমা ও সেলিম। দু’জনেরই শিকড় মেদিনীপুরে। সেলিমের আবছা মনে পড়ে নন্দীগ্রামের কথা। সালমারও ঘাটালের স্মৃতি ঝাপসা। কোন ছেলেবেলায় দু’জনেই এসেছিলেন কলকাতায়। কেউ কাউকে চিনতেন না। হোটেল, মুটে, কুলি, রিকশা টানা— এ শহরে প্রায় কোনও কাজই বাকি রাখেননি সেলিম। সালমাও শ্যামবাজারে একটি বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতেন। বছর চল্লিশ আগে এক বিয়েবাড়িতে হঠাৎ দেখা সেলিম-সালমার। ঘরহারা দুই তরুণ-তরুণী মনে মনে বাঁধা পড়ে যান সে দিনই। কাজি ডেকে কবুল বলাটা ছিল স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। কলকাতা থেকে দূরে ডোমজুড়ের জঙ্গলপুরে এক চিলতে বাসা ভাড়া নেন তাঁরা। বছর কয়েক বাদে জন্মায় সন্তান বাবু। কিন্তু সেলিম-সালমার একমাত্র বন্ধন, বাবুও কৈশোর পেরোতেই পাড়ি দেয় ত্রিপুরা। আর ফেরেনি।
মিঞা-বিবির সংসারের পাশেই জুতো সারাইয়ের দোকান শোভাবাজারের শঙ্কর দাসের। তিনি বললেন, ‘‘বহু মানুষ ফুটপাথে থাকেন। কিন্তু কোনও আক্ষেপ, অভিযোগ ছাড়া এ ভাবে প্রাণ খুলে হেসে বেঁচে থাকা? নাহ্, আগে কখনও দেখিনি।’’
পড়ন্ত বিকেলে ডানা মুড়ে ঘরে ফেরে পাখি। স্বামীর জন্য দোকান থেকে ফের দুধ চা আনেন সালমা। প্লাস্টিকের পলকা কাপে সুড়ুৎ করে একটা চুমুক দিয়ে বৃদ্ধ বলেন, ‘‘এ বার চিনিটা ঠিকঠাক।’
মুচকি হাসেন সালমা। মুহূর্তে সবুজ হয়ে ওঠে কংক্রিটের শহর। সন্ধ্যার তিলোত্তমা সেজে ওঠে আলোর মালায়। ফুটপাথের সংসারেও ধোঁয়া ছাড়ে মশা মারার ধূপ। জ্বলে ওঠে লিকলিকে মোমবাতি।
এ শহর সত্যিই ম্যাজিক জানে!