ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। ফাইল চিত্র।
ডেঙ্গিতে মৃত্যু-মিছিল থামার কোনও লক্ষণ নেই। গত ৭২ ঘণ্টায় ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে আরও তিন জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। কলকাতা ও লাগোয়া বিধাননগরের বাসিন্দা ওই তিন জনেরই বয়স কুড়ি থেকে তিরিশের মধ্যে। তাঁদের এক জনের আবার আগে পরপর দু’বছর ডেঙ্গি হয়েছিল। চলতি বছরে রাজ্যে ডেঙ্গি পরিস্থিতি যথেষ্ট উদ্বেগজনক। মৃত্যুর লেখচিত্রও ঊর্ধ্বমুখী। চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণ, চলতি মরসুমে মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্ত হয়ে কমবয়সিদের মৃত্যুর হারও বেশি। আর যাঁদের দ্বিতীয় বার ডেঙ্গি হচ্ছে, তাঁরা মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকছেন।
রাজ্যে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ২০১৯ সালের সংখ্যাকে ছাপিয়ে গিয়েছে। চিকিৎসকদের মতে, মৃত্যু যে হারে বাড়ছে, তাতে চলতি বছর ছাপিয়ে যেতে পারে তিন বছর আগের মৃত্যুর সংখ্যাকেও। জানা গিয়েছে, মৃত সায়ন ঘোষ চৌধুরী (২৫) এবং সুকন্যা মজুমদার (২৬) কলকাতা পুরসভা এলাকার বাসিন্দা। আর বিধাননগরের বাসিন্দা হলেন রাহুল সাহা (২২)। এক স্বাস্থ্য আধিকারিকের কথায়, ‘‘পরিস্থিতি যে উদ্বেগজনক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গত এক সপ্তাহে সরকারি হাসপাতালেই ভর্তি হয়েছেন তিন হাজারের বেশি মানুষ। তার মধ্যে অনেকেই সঙ্কটজনক হওয়ায় মৃত্যুও বাড়ছে।’’
সুকন্যার পরিবার জানিয়েছে, ২০১৬ ও ২০১৭ সালেও ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক অনির্বাণ দলুই জানাচ্ছেন, ডেঙ্গির ১, ২, ৩, ৪— এই চার রকম সেরোটাইপ রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, তিন-চার বছর পরেপরে অন্য স্ট্রেন ফিরে আসছে। তাই কেউ যদি কয়েক বছর আগে ডেং-১-এ আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তা হলে তাঁর যে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হবে, অন্য স্ট্রেনে আক্রান্ত হলে সেটি আর কাজে আসবে না। উল্টে ‘হাইপার-ইমিউনো’ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। শরীরে সাইটোকাইন ঝড় তৈরি হবে। তাঁর কথায়, ‘‘এর ফলে রক্তক্ষরণ ও শকে চলে যাওয়ার মতো মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। সেকেন্ডারি ডেঙ্গি সংক্রমণ খুব বিপজ্জনক। এতে রোগীর অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়। আর এই সেকেন্ডারি ডেঙ্গিতে কমবয়সিদের আরও বেশি করে শরীর খারাপ হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তাই বয়স কম হলেই ডেঙ্গিকে প্রতিহত করতে পারব, এমন ভাবার কারণ নেই।’’
কলকাতা পুরসভার ৯২ নম্বর ওয়ার্ডের ঢাকুরিয়ার নস্করপাড়া লেনের বাসিন্দা সুকন্যার ১৪ অক্টোবর রাতে জ্বর আসে। পরের দিন স্থানীয় চিকিৎসককে দেখানো হয়। ১৬ অক্টোবর পরীক্ষায় ডেঙ্গি পজ়িটিভ ধরা পড়লে রাতেই তাঁকে ই এম বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁর কাকা প্রণবকুমার মজুমদার বলেন, ‘‘১৯ অক্টোবর সকাল থেকে ওর অবস্থার অবনতি হতে থাকে। পেটে, বুকে ব্যথা হচ্ছিল। সঙ্গে ঘন ঘন বমি। পায়খানার সঙ্গে রক্ত বেরিয়েছিল বলেও জানিয়েছিল। রাতে অবস্থার অবনতি হলে জেনারেল বেড থেকে আইসিইউ-তে স্থানান্তরিত করা হয়। গভীর রাতে মৃত্যু হয়।’’ গত ২৫ সেপ্টেম্বর ওই ওয়ার্ডের এক মহিলাও ডেঙ্গিতে মারা যান।
আবার ১১৪ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব পুটিয়ারির শ্রীপল্লির বাসিন্দা সায়নের গত সোমবার জ্বর আসে। বাড়িতেই চিকিৎসা চলছিল। অবস্থার অবনতি হওয়ায় গত বৃহস্পতিবার তাঁকে এম আর বাঙুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবারের সদস্যদের বক্তব্য, সেখানে শয্যা না পাওয়ায় বেহালার একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয় তাঁকে। শুক্রবার সকাল থেকে সায়নের অবস্থার অবনতি হতে থাকে। প্লেটলেট ৪০ হাজারে নেমে যায়। শুক্রবার গভীর রাতে তাঁর মৃত্যু হয়। ওই ওয়ার্ডে এর আগেও এক জনের মৃত্যু হয়েছে। শনিবার সকালে পুরসভার কর্মীরা সায়নের বাড়ির আশপাশে এলে স্থানীয় বাসিন্দারা বিক্ষোভ দেখান।
কলকাতার পাশাপাশি আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যায় পাল্লা ভারী হচ্ছে বিধাননগরেরও। এক সপ্তাহের মধ্যে বিধাননগরের ১০ নম্বর ওয়ার্ডে দু’জনের মৃত্যু হল। গত ১৮ অক্টোবর ওই ওয়ার্ডেরই বাসিন্দা এক ১৪ বছরের কিশোরীর মৃত্যুহয়েছিল। শুক্রবার মৃত্যু হল রাহুলের। এ পর্যন্ত বিধাননগরে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা চার। দেশবন্ধু নগরের বাসিন্দা রাহুলের গত ১৪ অক্টোবর জ্বর আসে। ১৭ অক্টোবর ডেঙ্গি ধরা পড়ে। সে দিনই তাঁকে সল্টলেকের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু সেখানে শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় বাইপাসের ধারের একটি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। শুক্রবার রাতে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। পেশায় মেডিক্যাল রিপ্রেজ়েন্টেটিভ ওই যুবকের পরিজনেরা জানান, ১৯ অক্টোবর বিকেলের পরেও রাহুল কথাবার্তা বলতে পারছিলেন। কিন্তু তার পরেই ধীরে ধীরে কথাবার্তা বন্ধ হয়ে যায়। সল্টলেকের ওই হাসপাতাল থেকে স্থানান্তরের সময়েই তাঁর পেটে জল জমতে শুরু করে দিয়েছিল।
মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে একই এলাকা থেকে পর পর দু’টি মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগ বাড়িয়েছে পুর কর্তৃপক্ষেরও। বিধাননগর পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের মেয়র পারিষদ বাণীব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলরকে নিয়ে বৈঠক করে জানার চেষ্টা করব, সমস্যা কোথায় হচ্ছে। কী করে ওয়ার্ডটিকে সেফ জ়োনে নিয়ে আসা যায়, তা-ও দেখা হবে।’’